বিশেষ প্রতিনিধি।।
গাছের ছায়ায় তাঁবুর নিচেই মসজিদে নামাজ পড়েন শতাধিক মুসল্লি। মসজিদে আজও নেই বিদ্যুতের ব্যবস্থা। নেই পানির লাইন। অজুর পানি আসে অন্য উপায়ে।
জুমার নামাজে তাকবির এবং খুতবায় ইমাম ব্যবহার করেন ব্যাটারিচালিত স্পিকার। সেই ব্যাটারির আলোতেই হয় ইফতার। আশপাশে কংক্রিটের মসজিদ থাকলেও, রমজানে মুসল্লিরা সেই তাঁবু মসজিদে নামাজ পড়ে তৃপ্তি পান।
তাদের অভিমত, শত বছরের বেশি সময় ধরে কলকাতার বুকে অবস্থান করছে তাঁবু মসজিদে। ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদেই নামাজ পড়ে পরিতৃপ্ত হন তারা।
কলকাতায় প্রায় দেড়শ’ বিঘা জায়গাজুড়ে বিস্তৃত জনপ্রিয় কেপিসি হাসপাতাল প্রাঙ্গণেই তাঁবু মসজিদের অবস্থান। একসময় এটাই ছিল ভারতের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ টিবি রোগীদের হাসপাতাল। কবি সুকান্ত এই হাসপাতালেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। পরে কেপিসি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষকে হাসপাতাল ও কলেজ গড়ার জন্য রাজ্য সরকার জমিটি হস্তান্তর করে। আজ সব ধরনের চিকিৎসা হয়। আছে মেডিকেল কলেজও।
কিন্তু দেশভাগের আগে, হাসপাতাল গড়ে ওঠা সেই দেড়শ’ বিঘা জমির চারিদিকে ছিল মুসলমানদের বাস। তাদের জন্যই ছিল এক ঈদগাহ। সেই স্থানেই রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন এই মসজিদ।
দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর। এক সময় সেখানে বাস করতেন প্রায় ৬০ শতাংশ মুসলিম। তারপর দেশভাগ, দাঙ্গা আরও কত কী। আজ মানুষগুলো নেই, রয়ে গেছে জমি। আর সেই জমিতে কত শত স্মৃতি বহন করে চলেছে তাঁবু মসজিদ। এই মসজিদের ইতিহাস কলকাতার বইয়ের পাতায় মিলবে না। তাই বঙ্গবাসীর নেই চর্চায়।
তৎকালীন সময় ঠিক হয় ঈদগাহের পাশেই তৈরি হবে মসজিদ। সেই মোতাবেক ১৯১১ সালে মসজিদ তৈরির ফলক স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু মসজিদ আর গড়ে ওঠেনি। এরপর ২০১১ সাল থেকে আইনি জটিলতা চলতেই থাকে। এখনও চলছে। তবে মামলা মসজিদ কমিটির পক্ষে। তবুও কমিটি আর কংক্রিটের মসজিদ গড়তে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কিন্তু কেন গড়ে উঠছে না কংক্রিটের মসজিদ? কারণ অনেকেই চায় পুরোনো স্মৃতি বহন করুক সেই জমি। যেমনটা বহুকাল ধরে হয়ে আসছে।
শতবর্ষ পুরোনো বিশাল এক গাছের নিচে বাঁশ পলিথিন এবং গাছের পাতাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়েই প্রথম থেকেই তৈরি তাঁবু মসজিদ। স্থানীয়রা চান পরিবেশ এরকমই থাক। কংক্রিটের চেয়ে এতেই নামাজ পড়ে আলাদা অনুভূতি প্রকাশ পায়।
যাদবপুর বিশ্ব বিদ্যালয়ের এমটেকের ছাত্র মনিরুজ্জামান বলেন, একসময় মহানবী রাসুল (সা.) নামাজ পড়তেন খেজুর পাতার ছাউনি দেওয়া চারদিক খোলা স্থানে। আমি যখন প্রথম এই মসজিদটা দেখি, আমার তখনকার কথা মনে পড়ে। এখানে সেই অনুভূতিটাই আসে। রসুল (সা.) যেই অনুভূতি পেয়েছেন আমরাও যেন সেই অনুভূতিটা পাই। তাই এরকমই থাক।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় স্কলার মাহমুদুল হাসান, আট বছর ধরে এই তাঁবু মসজিদে নামাজ পড়ছেন। তিনি বলেন, এখান থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথে সুলেখার মোড়ে আরো একটি মসজিদ আছে। তবে সেটি কংক্রিটের। কিন্তু এইখানে নামাজ পড়ে যে অনুভূতিটা পাই তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সবাই মিলে এখানে নামাজ পড়ি। একটা সুন্দর যোগসূত্র তৈরি হয়। বিশেষ করে নবীজি তাঁর আমলে খেজুর পাতার ছাউনিতে নামাজ পড়তেন, সেই অনুভূতিটা আমরা পাই। যে কারণে এখানে আসি।
অঞ্চলটি এখন হিন্দু অধ্যুষিত। সেখানে নামাজ পড়েন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ওই হাসপাতালে শিক্ষার্থীসহ আশপাশের কিছু মুসল্লি। যোগ দেন রোগীর স্বজনরাও। কেপিসির কিছু সংখ্যক চিকিৎসক এই তাঁবু মসজিদে নামাজ পড়েন।
মসজিদে বহুবছর ধরে রয়েছেন এক বাঙালি ইমাম। তার নাম মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম। বর্তমানে এই তাঁবু মসজিদের দায়িত্বে আছেন তিনি।
তিনি বলেন, এখানে আমাদের আত্মার শুদ্ধি হয়। এখানে যারা নামাজ পড়েন তাদের মনোযোগ অনেকটাই বাড়ে। যেটা আমি ভাষায় ব্যাখ্যা করতে পারবো না। যে কারণে চিকিৎসক থেকে রোগীর স্বজন, শিক্ষার্থীরা নিয়মিত আসেন। অনেকেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন।
ইমাম আরও বলেন, মনে রাখতে হবে এটা হাসপাতাল, রোগীদের স্থান। ফলে লাউড স্পিকার ব্যবহার করি না আমরা। কাউকে কষ্ট দিলে ইবাদত হবে না। আমার আরাধনা এমনই হবে যাতে কেউ কষ্ট না পায় অথবা আমি কাউকে কষ্ট না দিই। এটাই শেখায় আমার ধর্ম। তবে হ্যাঁ মাঝেমধ্যে গাছের ডাল পরে পলিথিন ফুটো হয়ে যায়, বর্ষার সময় পানি পড়ে তবু আমরা আবার সারিয়ে নিই। থাক না কলকাতার বুকে এরকম একটা মসজিদ। চারিদিকে তো কংক্রিট আর কংক্রিট। আমাদের যখন সমস্যা হচ্ছে না তখন নতুন করে সমস্যা বাড়িয়ে লাভ কি!
তবে রাজপাট গেলেও রাজত্ব যায়নি। যতটুকু জমির মধ্যে এই মসজিদ অবস্থিত, তা এখনও খুরশিদ আলম পরিবারের সম্পত্তি। একসময় তাদেরই সম্পত্তি ছিল দেড়শত বিঘা। তবে আজ সব অতীত। সেই জমিতে বিরাজ করছে শত বছরের ইতিহাস আর তাঁবু মসজিদ।