রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি। তারই ধারাবাহিকতায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবস। সারাদেশের ন্যায় সকল শহীদের স্মরণে চৌহালী বাসি শ্রদ্ধা জানায়। ভাষা আন্দোলনের ৭৪ বছর ও স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন এর জন্মভূমি চৌহালীতে গড়ে উঠেনি কোন পাঠাগার, শহীদ মিনার, ভাস্কর্য ও স্মৃতি ফলক। মায়ের ভাষা রক্ষায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের অনুপ্রেরণা হচ্ছে ভাষা আন্দোলন। সেই ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে বাঙালি পেয়েছে মুক্তির সংগ্রামের উজ্জীবনী শক্তি ও সাহস। ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ এলেই সর্বপ্রথম যার মুখটি বাঙালির সামনে ভেসে ওঠে, তিনি হলেন ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন।
ভাষা আন্দোলনের পর থেকে তিনি ‘ভাষা মতিন’ বা ছাত্র মতিন নামেই বাঙা

লির কাছে সর্বাধিক পরিচিত। ভাষা আন্দোলনে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় ও অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন অকুতোভয় এক সংগ্রামী নেতা। ছাত্রজীবন থেকে আমৃত্যু সেই সংগ্রামে অবিচল থেকে বলে গেছেন শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজের কথা। ভাষা আন্দোলন থেকে যুক্তফ্রন্ট ও নির্বাচনী বিজয়। শৃঙ্খল ভাঙার গানে উজ্জীবিত অনেক ছাত্র-যুবার কাছে তখন প্রথাগত শিক্ষার চেয়ে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নই বড় হয়ে দেখা দেয়, আব্দুল মতিন ছিলেন তাঁদেরই একজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন মতিন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে তিনি এর আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন। ১৯৫২ সালে তুমুল আন্দোলনে তিনি নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন। তাঁদের সেই আন্দোলনের পথ ধরেই বাঙালি পায় মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার। এই ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে কারাগারে নানা বন্ধুর সাহচর্যে নতুন আদর্শে দীক্ষা নেন। সে আদর্শ সমাজ বদলের; বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার। এ স্বপ্ন পূরণের লড়াইয়ে জেল-জুলুম নির্যাতন কোনো কিছুতেই বিচ্যুত হননি ভাষা মতিন। আব্দুল মতিন ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার উমারপুর ইউনিয়নে ধুপুলীয়া গ্রামে এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আবদুল জলিল ও মায়ের নাম আমেনা খাতুন। তিনি ছিলেন তাঁদের প্রথম সন্তান। জন্মের পর তাঁর ডাক নাম ছিল ‘গেদু’। ১৯৩০ সালে গ্রামের বাড়ি যমুনা নদীর ভাঙ্গনের শিকার হলে আবদুল জলিল জীবিকার সন্ধানে ভারতের দার্জিলিংয়ে চলে যান। সেখানে জালাপাহারের ক্যান্টনমেন্টে সুপারভাইজ স্টাফ হিসেবে একটি চাকরি পেয়ে যান। ১৯৩২ সালে আবদুল মতিন শিশু শ্রেণিতে দার্জিলিংয়ের বাংলা মিডিয়াম স্কুল মহারানী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেন। এই বিদ্যালয়েই শুরু হয় তাঁর শিক্ষা জীবন। ১৯৩৩ সালে আবদুল মতিনের মাত্র ৮ বছর বয়সে তাঁর মা অ্যাকলেমশিয়া রোগে মারা যান। মহারানী গার্লস স্কুলে ৪র্থ শ্রেণি পাস করলে এখানে প্রাথমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ হয়। এরপর ১৯৩৬ সালে দার্জিলিং গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। তিনি ১৯৪৩ সালে এনট্রান্স (মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা) পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ নিয়ে উত্তীর্ণ হন। আবদুল মতিন ১৯৪৩ সালে রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে ভর্তি হলেন। দুই বছর পর ১৯৪৫ সালে তিনি এইচএসসি পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ নিয়ে উত্তীর্ণ হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে আবদুল মতিন ব্রিটিশ আর্মির কমিশন র্যাঙ্কে ভর্তি পরীক্ষা দেন। দৈহিক আকৃতি, উচ্চতা, আত্মবিশ্বাস ও সাহসিকতার বলে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম থেকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কমিশন পান। এরপর তিনি কলকাতা থেকে বেঙ্গালুরু গিয়ে পৌঁছান। কিন্তু তত দিনে যুদ্ধ শেষ। ফলে তিনি একটি সার্টিফিকেট নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। প্রত্যাবর্তনের পর তিনি ১৯৪৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব আর্টসে (পাস কোর্স) ভর্তি হলেন। ফজলুল হক হলে তাঁর সিট হয়। ১৯৪৭ সালে গ্র্যাজুয়েশন কোর্স শেষ করেন এবং পরে মাস্টার্স করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে। মাতৃভাষা মানুষের জন্মগত অধিকার। পৃথিবীর সব ভাষাভাষী মানুষই নিজের ভাষায় কথা বলবে, এটিই স্বাভাবিক। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু ভাষার ওপর আঘাত অর্থাৎ একটি ভাষাভাষীর মানুষের ওপর অন্য একটি কৃত্রিম ভাষা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এমনই একটি বিরল ও ঘৃণ্য ঘটনা ঘটে ১৯৪৮ সালে। অগণতান্ত্রিক ও অযৌক্তিক ভাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দুঃসাহস দেখালেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি ঢাকায় এসে ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সমাবর্তন ভাষণে ঘোষণা দিলেন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হবে। কথাটা উচ্চারণের পরপর আবদুল মতিনের কণ্ঠ থেকেই প্রথম উচ্চকণ্ঠের প্রতিবাদ ‘নো, নো’ ধ্বনিত হয়েছিল। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে একে শুধু সাহসিকতা বলা চলে না, রীতিমতো বলতে হবে একটা দুঃসাহসিক কাজ। আবার ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার ঘোষিত ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে ১১-৩ সংখ্যা গরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত অমান্য করার পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী ছাত্রদেরও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই আবদুল মতিন। পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্তটিই পাস হয়েছিল তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণের প্রভাবে। তার পরের ইতিহাস আমাদের সবার জানা। রাজপথে বুকের রক্ত দিয়ে ছাত্র-জনতা মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করে। পৃথিবীর বুকে মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন করে প্রাণের আত্মত্যাগের ঘটনা এটাই প্রথম। বিশ্ববাসীর কাছে এটা বাঙালির জন্য বিরাট এক গৌরব। এমন একটি ইতিহাস রচনায় যাঁর নেতৃত্ব ছিল অগ্রগামী, তিনি নিঃসন্দেহে বাঙালি জাতির এক কীর্তিমান বীরপুরুষ। ভাষা আন্দোলনের পর তিনি ছাত্র ইউনিয়ন গঠনে ভূমিকা রাখেন এবং পরে সংগঠনটির সভাপতি হন। এরপর কমিউনিস্ট আন্দোলনে সক্রিয় হন। ১৯৫৪ সালে পাবনা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক হন আবদুল মতিন। মাওলানা ভাসানী ন্যাপ গঠন করলে তিনি ১৯৫৭ সালে তাতে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তিনি পাবনা জেলাকে ভিত্তি করে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) ভেতরে আলাউদ্দিন আহমদকে নিয়ে এক উপদল গড়ে তোলেন। পরে তিনি দেবেন শিকদার, আবুল বাশার, আলাউদ্দিন আহমদ ও নুরুল হক চৌধুরীর সহায়তায় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন। টিপু বিশ্বাস, আলাউদ্দিন আহমদ ও তাঁর নেতৃত্বে পাবনা জেলার জনগণ মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। নতুন প্রজন্মের কাছে অবিস্মরণীয় স্মৃতি ধরে রাখতে চৌহালী উপজেলা সদরে ছাত্র মতিন, ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন এর নামে স্মৃতি-ফলক এবং শহীদ মিনার নির্মানে উপজেলা বাসির দাবি ও বিভিন্ন তথ্য সূত্রে গৃহীত এ প্রতিবেদন। #### মাহমুদুল হাসান চৌহালী সিরাজগঞ্জ