বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা ॥বীর মুক্তি যোদ্ধা ওস্তাদ দবির উদ্দিন কে নিয়ে লেখা- কন্যা জয়া
আজ বিজয় দিবসের এই ক্ষনে আমার আব্বাকে নিয়ে কিছু লিখবো। জানিনা কতটুকু পারবো । আব্বাকে নিয়ে লেখা , বা উনার জীবনকে বিশ্লেষণ করার মত ক্ষমতা আমার নেই । তবুও এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা॥
মুক্তি যুদ্ধ যখন শুরু হয় আমি তখন অনেক ছোট । ২৬শে মার্চের আগে থেকেই দেখতাম আমাদের বাসায় অনেকে আসতো, আব্বা তাদের সাথে কি যেন সব আলোচনা করতো, তারপর দেখতাম আমাদের বাড়ীর উঠানে তাদের শেখাতেন যুদ্ধের সব কলাকৌশল। এখানে বলে রাখি আব্বা বৃটিশ আর্মির অবসর প্রাপ্ত সুবেদার মেজর ছিলেন , এবং ২য় বিশ্ব যুদ্ধে উনি চায়না ফ্রন্টে বৃটিশ সেনাবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন।
পরবর্তীতে আমাদের এলাকার সেন্ট্রাল হাইস্কুলে মুক্তি যোদ্ধাদের অস্ত্র চালনা ও যুদ্ধের কলাকৌশলের প্রশিক্ষন দিতেন। তারপর একদিন দেখলাম আব্বা আমাদের আম্মাসহ ছোট ছোট চার বোন ও দুই ভাইকে রেখে যুদ্ধে অংশ নিতে আরও বড় ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
আমাদের বড়ভাই তখন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে চাকরী সূত্রে পাকিস্তানের কোয়েটাতে বন্দি ছিলেন ।
তারপর যুদ্ধ চলাকালীন পুরোটা সময় আমার গর্ভবতী মা আমাদের এতগুলো ভাইবোনকে নিয়ে আমাদের এক দুর সম্পর্কের ফুপুর বাসায় অনেক কষ্টের মধ্যদিয়ে পার করেছেন। তখন ছোট ছিলাম বলে বুঝিনি, কিন্তু পরে বড় হয়ে বুঝেছি মা কত কষ্ট সহ্য করেছেন।
তারপর দেশ স্বাধীন হলো আর স্বাধীনতার সেই দিন ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনীর কামানের আঘাতে প্রায় ভেঙে যাওয়া ঘরে আমাদের সবার ছোট বোন জয়ন্তীর জন্ম হয়।
আব্বা যুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় দুইমাস পরে বাড়ী ফিরেছিলেন। কারন আব্বা ভারতের পতিরামে যে ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন, সেখানে তিনি ২,৫০০ বেশি মুক্তি যোদ্ধাকে প্রশিক্ষন দিয়েছিলেন, তাদের অনেকে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। আব্বা নিজ দায়িত্বে তাদের পরিবারকে সে সংবাদ পৌঁছানোর ব্যবস্হা করেছেন , অন্যান্য যারা এই ক্যাম্পের বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন তাদের সকলকে বাডী ফেরার ব্যবস্হা করে তারপর নিজে বাড়ীতে ফিরেছিলেন।
আমার আজও সে দিনটি পরিস্কার মনে পড়ে ।আমাদের ভাঙা বাড়ীতেই সেদিন মানুষের ঢল নেমেছিল আব্বার সাথে দেখা করার জন্য, উনার কাছে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা শোনার জন্য।
তারপর অনেক সময় পার হয়েছে, আমরা বড় হয়েছি মধ্যবিত্তের টানাপড়েন এর মধ্য দিয়ে কিন্ত আব্বা কখনও কোন সুযোগ সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেননি একজন মুক্তিযাদ্ধা হিসাবে। উনি সবসময় বলতেন আমি দেশের জন্য যা করেছি সেটা আমার দায়িত্ব ছিল, এর বিনিময়ে কিছু পাওয়ার আশায় নয়।
তারপর ১৯৭৯ সালের ২৭শে জুন আব্বা হঠাৎ করে হার্ট এটার্কে মারা যান। আমরা পাঁচ বোন সবাই তখন ছোট, বড় দুইভাই সরকারী চাকুরী করেন , ছোটভাই মাত্র পলিটেকনিক থেকে পাশ করেছেন । আব্বার পেনশনের টাকা পেতে আম্মাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে , কারও কাছে কোন সাহায্য পাননি।
তারপর…… আম্মাও একদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, ভাইবোন সবাই যার যার জীবনে ব্যস্ত, আমি স্বামী সন্তানসহ দেশের বাইরে । তবে আমার ছোটবোন জয়ন্তীর চেষ্টা , আমাদের বগুড়ার কিছু গন্যমান্য ব্যক্তি ও সাংবাদিক যাদের একজন বগুড়ার এটিএন প্রতিনিধি চপল সাহা ও প্রতীক ওমর এর আন্তরিক সহযোগিতায় আমার আব্বার নাম মুক্তিযাদ্ধা হিসাবে গন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারী গেজেটে স্হান পেয়েছে ।
স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছর পর আমার আব্বার মত এমন একজন দেশ প্রেমিকের নাম গেজেটভুক্ত হয়েছে , এটা কি আমাদের দেশের জন্য লজ্জার নাকী গর্বের???
তবে আমরা কৃতজ্ঞ সবার কাছে, যারা এব্যাপারে সর্বাত্বক সহযোগিতা করেছেন। আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে আমার আব্বা দেশের একজন গর্বীত মুক্তিযাদ্ধা ছিলেন।
সব শেষে আমার ছোট বোন জয়ন্তী ও আমার দেশ বাংলাদেশ কে জন্মদিনের অনেক অনেক শুভকামনা !!
ছোট বোন জয়ন্তী ও আমার দেশ বাংলাদেশ কে জন্মদিনের অনেক অনেক শুভকামনা !!
এ বিভাগের আরও খবর...