আল্লাহতায়ালা গোটা বছরের প্রত্যেক রাতের মধ্যে যে একটি রাতের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, সেটি হলো, ‘লাইলাতুল কদর’ বা মর্যাদার রাত। আল্লাহতায়ালার ভাষায়, ‘নিশ্চয় আমি এটি (কোরআন) নাজিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী।
সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়। ’ আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘নিশ্চয় আমি এটি নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। তোমাকে কিসে জানাবে লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতারা ও রূহ (জিবরাইল) তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করে। শান্তিময় সেই রাত, ফজরের সূচনা পর্যন্ত। ’
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘লাইলাতুল কদরে যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের নিয়তে কিয়াম করবে, তার পূর্বের সকল পাপ মোচন করা হবে। ’ -সহিহ মুসলিম: হাদিস নং ৭৬০; সহিহ বোখারি: হাদিস নং ২০১৪
তাই এই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হওয়া চরম দুর্ভাগ্যের বিষয়। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রমজান মাসের আগমন ঘটলে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের উদ্দেশে বললেন, তোমাদের নিকট এই মাস সমাগত হয়েছে, তাতে এমন একটি রাত রয়েছে, যা এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল, সে প্রকৃতপক্ষে সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত। একমাত্র (সর্বহারা) দুর্ভাগাই এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়। ’ -সুনানে ইবনে মাজা: হাদিস নং ১৬৪৪
তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত, ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল ও অন্যান্য নেক আমলের মাধ্যমে এ রাতের খায়ের-বরকত লাভে সচেষ্ট থাকা।
মাসয়ালা : অনেকের মনে এই ভুল ধারণা রয়েছে যে, সাতাশের রাতই হচ্ছে শবে কদর। এই ধারণা সঠিক নয়। সহিহ হাদিসে এসেছে যে, রাসূলে কারিম (সা.) কে লাইলাতুল কদর কোন রাত তা জানানো হয়েছিল। তিনি তা সাহাবিদেরকে জানানোর জন্য আসছিলেন, কিন্তু ঘটনাক্রমে সেখানে দুই ব্যক্তি ঝগড়া করছিল। তাদের ওই ঝগড়ার কারণে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট থেকে সে রাতের ইলম উঠিয়ে নেওয়া হয়। এ কথাগুলো সাহাবিদেরকে জানানোর পর নবী করিম (সা.) বললেন, হতে পারে, এতেই তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে। এখন তোমরা এ রাত (অর্থাৎ তার বরকত ও ফজিলত) রমজানের শেষ দশকে অন্বেষণ কর। -সহিহ বোখারি: হাদিস নং ২০২০, সহিহ মুসলিম: হাদিস নং ১১৬৫/২০৯
অন্য হাদিসে বিশেষভাবে বেজোড় রাতগুলোতে শবে কদর তালাশ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। -সহিহ মুসলিম: হাদিস নং ১১৬৫
তাই সাতাশের রাতকেই সুনির্দিষ্টভাবে লাইলাতুল কদর বলা উচিত নয়। খুব বেশি হলে এটুকু বলা যায় যে, এ রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার অধিক সম্ভবনা রয়েছে।
ইবনে হিব্বানের এক বর্ণনায় আছে, ‘তার আলামত হচ্ছে সেদিন সকালে সূর্য উদিত হবে সাদা, তার কোনো কিরণ থাকবে না, যেন তার আলো মুছে দেয়া হয়েছে। ’
ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় লাইলাতুল কদর হচ্ছে রমজানের শেষ সাতের মাঝখানে, সেদিন সকালে শুভ্রতা নিয়ে সূর্য উদিত হবে, তার মধ্যে কোনো কিরণ থাকবে না। ইবনে মাসউদ বলেন, আমি সূর্যের দিকে তাকিয়ে সেরূপ দেখেছি, যেরূপ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন। ’ -মুসনাদে আহমদ
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) লাইলাতুল কদর সম্পর্কে বলেছেন, ‘এটা হচ্ছে সাতাশ অথবা ঊনত্রিশের রাত, সে রাতে কঙ্করের চেয়ে অধিক সংখ্যায় ফেরেশতারা পৃথিবীতে অবস্থান করেন। ’ -মুসনাদে আহমদ
অর্থ: ‘হে আল্লাহ তুমি ক্ষমাশীল, মহানদাতা-সম্মানিত, ক্ষমা করা ভালোবাস, অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা কর। ’ইমাম তিরমিজি হাদিসটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন এ হাদিস হাসান, সহিহ।
শবে কদর রহস্যাবৃত থাকার রহস্য
শবে কদর রহস্যাবৃত থাকা সম্পর্কে ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো-
ক. শবে কদর নির্দিষ্ট করা হলে অনেক গাফেল (অলস) লোক অন্যান্য রাতে ইবাদত করাই ছেড়ে দেবে।
খ. অনেক লোক রয়েছে যারা পাপকর্ম ছাড়া থাকতে পারে না- তারিখ নির্ধারিত থাকলে যদি জেনে-শুনে কোনো ব্যক্তি পাপকর্মে লিপ্ত হতো, তবে সেটা তার জন্য অধিক বিপজ্জনক হতো। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা প্রণিধানযোগ্য। একবার নবী করিম (সা.) দেখলেন, এক সাহাবি মসজিদে ঘুমাচ্ছেন। তিনি হজরত আলীকে বললেন, আলী যেন ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগিয়ে অজু করতে বলেন। হজরত আলী এ নির্দেশ পালন করার পর হুজুর (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি তো সকল পুণ্য কাজেই অগ্রগামী, এ ব্যাপারে আপনি নিজে তাকে না বলে আমাকে দিয়ে জাগানো ও বলানোর তাৎপর্য আছে কি? হুজুর (সা.) বললেন, আমার ভয়, ঘুমের ঘোরে পাছে সে ব্যক্তি গাত্রোত্থান করতে অসম্মত হয় আর নবীর কথা অমান্য করায় কুফরিতে নিপতিত হয়ে পড়ে। তোমার কথায় অস্বীকৃতি জানালে কুফরি হতো না।
গ. শবে কদর নির্দিষ্ট থাকলে এবং ঘটনাচক্রে কোনো ব্যক্তি ওই রাতে ইবাদত হতে বঞ্চিত হলে এ শোকে সে পরবর্তী রাতগুলোতে আর ইবাদতের জন্য জাগতে পারত না।
ঘ. শবে কদরের ইবাদত করার উদ্দেশ্যে যেসব রাতে জাগরণ করা হয়, সেসব রাতের স্বতন্ত্র নেকি পাওয়া যায়। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) রাতের নফল নামাজে এক এক রাকাতে পূর্ণ কোরআন শরিফও খতম করে দিতেন।