নগর সংবাদ।।নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে জুয়ার টাকা জোগার করতে মা ও ছেলেকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। একইসঙ্গে এ ঘটনায় করা মামলায় প্রধান আসামি সাদিকুর রহমান সাদিকে (২৪) গ্রেফতার করা হয়েছে। সাদিকুরের বাবার নাম মোবারক হোসেন।
সংস্থাটির দাবি, গত রোববার (৩ জুলাই) প্রধান আসামি আইপিএলের জুয়ার টাকা সংগ্রহ করতে এবং স্বর্ণালঙ্কারের লোভে রাজিয়া সুলতানা ও তার শিশু সন্তান তালহাকে বটি দিয়ে জবাই করে হত্যা করে।
এর আগে গত শুক্রবার (৯ জুলাই) আসামিকে আড়াইহাজারের তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পিবিআই। আসামি সাদিকুর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়েছে পিবিআই।
সোমবার (১১ জুলাই) দুপুরে ধানমন্ডির পিবিআই কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার।
গত ৩ জুলাই দিনগত রাতে কোনো একসময় আড়াইহাজারের ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়নের উজান গোবিন্দপুর এলাকার একটি বাড়ি থেকে মা ও ছেলেকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। পরদিন সকালে মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। রাজিয়ার স্বামী আউয়াল বছর চার আগে মারা গেছেন বলে জানা যায়।
বনজ কুমার বলেন, ভিকটিমের মা বাদী হয়ে গত ৫ জুলাই আড়াইহাজার থানায় হত্যা মামলা দায়ের করে। লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি প্রিন্ট মিডিয়া, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেলে সারাদেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিলে আড়াইহাজার থানা পুলিশ, সিআইডি, র্যাবের পাশাপাশি পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলাও ব্যাপক গুরুত্বের সঙ্গে মামলাটির ছায়া তদন্ত শুরু করে। গত ৯ জুলাই মামলার তদন্ত শুরু করে পিবিআই।
পিবিআই জানায়, এ মামলা তদন্ত করতে গিয়ে নিহতদের বাড়ির পেছনে একটি সুপারি গাছের গায়ে লেগে থাকা কাদামাটির সূত্র ধরে হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তি শনাক্ত করা হয়।
সংস্থাটি বলছে, ভারতীয় টি-টোয়েন্টিলিগ আইপিএলের ম্যাচে জুয়া খেলে ৭০ হাজার টাকা ঋণ হয়ে যায় আসামির। এ টাকার জন্য পাওনাদারদের চাপের কারণে টাকা জোগাড় তিনি এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। আসামি সাদিকুর রহমান সাদিক হত্যার শিকার রাজিয়া সুলতানার চাচা শ্বশুরের ছেলে।
পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, আসামিকে গ্রেফতারের পাশাপাশি তার বাসা থেকে লুট করা স্বর্ণালঙ্কার ও হত্যায় ব্যবহৃত ধারালো বটি উদ্ধার করা হয়েছে। এলাকায় নম্র, ভদ্র ও নামাজি ছেলে হিসেবে পরিচিত পেশায় পোশাক শ্রমিক সাদিকুর ওরফে সাদিক জুয়ার ঋণের টাকা পরিশোধ করতে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে।
যেভাবে হত্যা করা হয়: গত ৩ জুলাই দিনগত রাত সাড়ে ১০টার দিকে সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর রাজিয়া সুলতানার বাড়ির সামনে গিয়ে ‘ভাবি ভাবি’ বলে ডেকে গেট খুলতে বলে সাদিকুর। কিছু সময় পর রাজিয়া দরজা খুলে কলাপসিবল কেচি গেট খুললে সাদিকুর জানায় তার মা তাকে ইলেকট্রিক বেল্ডার ধার নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছে। এই বলে ঘরের ভেতরে ঢুকে সে। এসময় শিশু তালহাকে (৮) ভাত খাওয়াচ্ছিলেন রাজিয়া। তালহা ঘুম ঘুম ছোখে ভাত খাচ্ছিলো।
পরে রাজিয়াকে পাশের রুমে আসার অনুরোধ করেন সাদিকুর। পাশের রুমে গেলে সাদিকুর তার হাতে পায়ে ধরে দশ হাজার টাকা ধার চান। টাকা চাইলে রাজিয়া তার কাছে কোনও টাকা নেই জানান। সাদিকুর অনেক জোর করার পর ঘরের আলমারি খুলে দিখিয়ে বলে ‘দেখ আলমারিতে শুধু ১০০ টাকা আছে। আর কোন টাকা নাই।’ আলমারিটা খুললে সে আলমারির ভেতরে একটি বাক্সে কিছু স্বর্ণের গয়না দেখতে পায়। অন্য জিনিসপত্র দেখতে পায়।
এরপর রাজিয়াকে চেয়ারে বসিয়ে বিছানার ওপর থেকে তার ব্যবহৃত ওড়না দিয়া গলায় ফাসঁ দেয় সাদিকুর। এতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেলে বিছানার পাশে রাখা ইস্ত্রি দিয়ে রাজিয়ার মাথায় সজোরে আঘাত করে। পুরোপুরি অজ্ঞান হয়ে গেলে সাদিকুর দ্রুত রান্না ঘর থেকে সবজি কাটার বটি এনে গলা কেটে তাকে হত্যা করে। শিশু তালহা হত্যাকাণ্ডটি দেখে ফেলেছে, এমন সন্দেহে পাশের রুমে ঘুমন্ত তালহাকেও বটি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। দুজনের মৃত্যু নিশ্চিত করে আলমারিতে থাকা স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে পালিয়ে যায় সাদিকুর।
হত্যাকারী চিহ্নিত হলো যেভাবে: অনুসন্ধানে তদন্তকারী কর্মকর্তারা দেখতে পান সুপারি গাছে কোনো ফল নেই। বিষয়টি সন্দেহের সৃষ্টি করে। তদন্তকারী কর্মকর্তারা স্থানীয় সোর্সের মাধ্যমে জানতে পারে এ বাড়িটির ফ্রি ওয়াইফাই সংযোগ থাকায় নিহত রাজিয়ার ভাসুরের ছেলে অজিদ কাজীসহ (১৬) স্থানীয় কয়েকটি ছেলে এখানে বসে মোবাইলে নেট ব্রাউজ করে ও অনলাইন গেমস খেলে। এমন তথ্যের পর অজিদ কাজীসহ অন্যদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে অজিদ জানায়, ঘটনার দিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাড়ির পেছনে দেয়াল ঘেঁসে বসে অনলাইনে মোবাইলে গেমস খেলছিলো। হঠাৎ নিহত তালহার একটি চিৎকার শুনতে পায়। এরপর বাথরুমে কারও হাত ধোয়ার শব্দ শুনতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে অজিদ বিল্ডিংয়ের পেছনে দেয়ালের সঙ্গে লাগানো সুপারি গাছ বেয়ে বাথরুমের ভেনটিলেটর দিয়ে উকিঁ দিয়ে দেখতে পান সাদিকুর ওরফে সাদিক রুমের এটাস্ট বাথরুমের পানির কলে হাত ধুচ্ছেন। এরপর সাদিকুরকে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে যেতে দেখে। সাদিকুর বের হয়ে যাওয়ার সময় ঘরের পেছনে অজিদ কাজীকে বসে থাকতে দেখে। পরের দিন সকাল বেলা হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে সাদিকুর অজিদ কাজীর সঙ্গে দেখা করে বলে- ‘আমার কথা কাউকে বললে তোরে জানে মেরে ফেলবো।’ এ ভয়ে অজিদ ঘটনা চেপে যায়।
বনজ কুমার বলেন, হত্যাকাণ্ডের পরদিন ঘাতক সাদিক নিহতদের মরদেহ দেখতে এলেও তাকে কেউ সন্দেহ করেনি। গার্মেন্টস শ্রমিক সাদিকুর এলাকায় নম্র, ভদ্র ও নামাজি ছেলে হিসেবে পরিচিত। কিন্তু জুয়ার ফাঁদে পরে ঋণের জালে জড়িয়ে যায়। এ টাকা পরিশোধের জন্য অনবরত তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে পাওনাদাররা। ফলে মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেন সাদিকুর। তদন্তে তার নাম বের হওয়ার আগ পর্যন্ত কারো সন্দেহের তালিকায় ছিলেন না তিনি। এমনকি হত্যার পরও বাড়িতেই ছিলেন ঘাতক সাদিকুর।
ঘাতকের ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন স্বজনরা: পিবিআই কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নিহত রাজিয়ার মা ও ছোট বোনসহ আত্মীয়স্বজনরা। রাজিয়ার মা ও মামলার বাদী খন্দকার তাসলিমা বেগম বলেন, আমার মেয়েকে যারা হত্যা করেছে, তাদের ফাঁসি চাই। যেভাবে আমার মেয়েকে হত্যা করেছে, তাদের ফাঁসি নিশ্চিত করা হোক।
নিজবাড়ি থেকে গ্রেফতার ঘাতক সাদিকুর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে। মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। সাদিকুর আদালতে দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানান পিবিআই প্রধান।