চট্টগ্রাম প্রতিনিধি।।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মদুনাঘাটে ব্যবসায়ী আব্দুল হাকিম হত্যা মামলার জটিল রহস্য উন্মোচন করেছে জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও হাটহাজারী মডেল থানা পুলিশ। একাধিক গোপন অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারীসহ ছয়জন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই সঙ্গে উদ্ধার হয়েছে বিদেশি পিস্তল, রাইফেল, রিভলভার, বিপুল গুলি, ইয়াবা, গাঁজা ও নগদ টাকা—যা গোটা জেলাজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর বিকেল। নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হামিম এগ্রো ফার্ম থেকে ফেরার পথে মদুনাঘাট ব্রিজের পশ্চিম প্রান্তে এলোপাতাড়ি গুলিতে ঝরে পড়ে ব্যবসায়ী আব্দুল হাকিমের জীবন
মোটরসাইকেলযোগে আসা দুর্বৃত্তরা তার গাড়ি লক্ষ্য করে একাধিক গুলি চালায়। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। অচিরেই এই হত্যাকাণ্ড চট্টগ্রামজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
গোপন সূত্রে অভিযান: একে একে ভাঙল রহস্যের জট,,৩১ অক্টোবর—রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের গরীব উল্লাহ পাড়া থেকে মোঃ আব্দুল্লাহ খোকন ওরফে ল্যাংড়া খোকন-কে গ্রেফতার করে পুলিশ। আদালতে সে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে হত্যাকাণ্ডে নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে।
তার তথ্যের সূত্র ধরে ২ নভেম্বর গ্রেফতার হয় মোঃ মারুফ, এবং ৪ নভেম্বর রাতে মোঃ সাকলাইন হোসেন-কে আটক করে পুলিশ। তার কাছ থেকে উদ্ধার হয় একটি একনলা বন্দুক, একটি এলজি ও হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল।
এরপর ৯ নভেম্বর রাতে, নোয়াপাড়ার চৌধুরীহাটে আইয়ুব আলী সওদাগরের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পুলিশ উদ্ধার করে বিদেশি অস্ত্র ও মাদকের বিশাল ভাণ্ডার।
অস্ত্র উদ্ধার অভিযান: যেন সিনেমার দৃশ্য: অভিযানে উদ্ধার হয়—৪টি বিদেশি পিস্তল, ১টি রিভলভার, ১টি চায়না রাইফেল, ১টি শটগান, ৪৯ রাউন্ড রাইফেল গুলি, ১৭ রাউন্ড শর্টগানের কার্তুজ, ১৯ রাউন্ড পিস্তলের গুলি, ৭টি ম্যাগাজিন, ২টি রামদা, ১টি রকেট ফ্লেয়ার, ৫০ পিস ইয়াবা, ২৫০ গ্রাম গাঁজা এবং ৯৬ হাজার টাকা নগদ। পুলিশ বলছে—এটি চট্টগ্রাম জেলায় সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ধার হওয়া সবচেয়ে বড় অবৈধ অস্ত্রের ভাণ্ডারগুলোর একটি।
হত্যার মূল কারণ: আধিপত্যের দ্বন্দ্ব ও বালুমহল দখলের প্রতিযোগিতা,তদন্তে জানা যায়, হাকিম ছিলেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। রাউজান-হাটহাজারী এলাকার বালুমহল দখল ও অর্থনৈতিক আধিপত্য নিয়ে চলমান দ্বন্দ্বই তাঁকে হত্যার দিকে ঠেলে দেয়। স্থানীয় আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা অবশেষে রক্তাক্ত পরিণতিতে পৌঁছে যায়, যার মাশুল দিতে হয় এক সফল ব্যবসায়ীকে।
গ্রেফতারকৃতরা হলেনঃ-১/ মোঃ আব্দুল্লাহ খোকন ওরফে ল্যাংড়া খোকন (বাগোয়ান, রাউজান),২/ মোঃ মারুফ (নোয়াপাড়া, রাউজান),৩/জিয়াউর রহমান (পাঁচখাইন, রাউজান),৪/মোঃ সাকলাইন হোসেন (পালোয়ানপাড়া, নোয়াপাড়া) ৫/মোঃ সাকিব (চৌধুরীহাট, রাউজান),৬/ শাহেদ (একই এলাকার বাসিন্দা)
পুলিশের প্রতিশ্রুতি: “চট্টগ্রামের মাটি কোনো সন্ত্রাসীর আশ্রয় নয়”চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার মোঃ সাইফুল ইসলাম সানতু, বিপিএম-বার বলেন—“হত্যাকাণ্ডের রহস্য সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয়েছে। মাস্টারমাইন্ডসহ প্রধান আসামিরা গ্রেফতার হয়েছে। বাকি সহযোগীদেরও ধরতে অভিযান চলছে।”
তিনি জানান, জেলার বিভিন্ন এলাকায় চেকপোস্ট, টহল ও সাঁড়াশি অভিযান জোরদার করা হয়েছে, যাতে কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পুনরায় সক্রিয় হতে না পারে।
হত্যার পর যে আতঙ্ক ও ভয় সৃষ্টি হয়েছিল, পুলিশের দ্রুত পদক্ষেপে তা অনেকটাই কেটে গেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ জেলা পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন— “চট্টগ্রামের মানুষ এখন জানে, অপরাধ করলে কেউ পার পাবে না।”
হাকিম হত্যাকাণ্ড ছিল শুধু একটি পরিকল্পিত হত্যা নয়; এটি ছিল স্থানীয় ক্ষমতা, অর্থ ও আধিপত্যের নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু জেলা পুলিশের সাহসিকতা প্রমাণ করেছে—চট্টগ্রাম এখন সন্ত্রাসমুক্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আইন ও ন্যায়বিচারের জয়ই এখানে শেষ কথা