নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণিত ও ভয়াবহ একটি দিন ১৬ জুনের বোমা হামলা। যা আজও অনেককে করে শিহরিত। ২০০১ সালের এই দিনে চাষাড়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পেছনে অবস্থিত আওয়ামী লীগ অফিসে শামীম ওসমানের পূর্ব নির্ধারিত গণসংযোগ কর্মসূচি চলাকালে রাত পৌনে ৯টায় বোমা হামলা চালানো হয়।
রাত পৌনে ৯টায় ভয়াবহ ওই বোমা হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ২০জন। নিহত ছাড়াও শামীম ওসমানসহ অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী আহত হন। বোমা হামলায় পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন শামীম ওসমানের ব্যক্তিগত সহকারি (তৎসময়কার) এবং বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক চন্দন শীলসহ অনেকেই।
এ ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হলেও দীর্ঘ ২১ বছরেও বিচারকাজ শেষ না হওয়ায় বিচার পাওয়া নিয়েই হতাশ নিহতের স্বজনরা।
শহর (সাবেক) ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি সাইদুল হাসান বাপ্পী, সরকারি তোলারাম কলেজ ছাত্রছাত্রী সংসদের সাবেক জিএস আকতার হোসেন, তাঁর ছোট ভাই সংগীত শিল্পী মোশারফ হোসেন মশু, সংগীত শিল্পী নজরুল ইসলাম বাচ্চু, ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ভাসানী, নারায়ণগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবিএম নজরুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা সাইদুর রহমান সবুজ মোল্লা, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী পলি বেগম, ছাত্রলীগ কর্মী স্বপন দাস, কবি শওকত হোসেন মোক্তার, পান সিগারেট বিক্রেতা হালিমা বেগম, সিদ্ধিরগঞ্জ ওয়ার্ড মেম্বার রাজিয়া বেগম, যুবলীগ কর্মী নিধু রাম বিশ্বাস, আব্দুস সাত্তার, মো. আবু হানিফ নূরী, এনায়েত উল্লাহ স্বপন, আব্দুল আলীম, শুক্কুর আলী, স্বপন রায় ও অজ্ঞাত এক মহিলা।
এদিকে, ১৬ জুন চাষাড়া আওয়ামী লীগ অফিসে হামলার ২১ বছরেও শনাক্ত করা যায়নি নিহত হওয়া অজ্ঞাত নারীর পরিচয়। সেদিনের ওই নারী কে ছিলেন, কোথা থেকে এসেছিলেন তিনি, এর কোনো খোঁজ ২১ বছরেও মিলে নি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী আজও পর্যন্ত তার পরিচয়, ঠিকানা এবং এখানে আসার কি কারণ ছিলো তার সন্ধান দিতে পারেনি।
আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীরাও জানেন না ওই মহিলাটি কে ছিলেন, এমনকি আজও পর্যন্ত ওই মহিলার কোনো স্বজনও খোঁজ করেনি তাকে। যার ফলে অজ্ঞাত সেই মহিলা আজও অজ্ঞাতই রয়ে গেছেন। রেখে গেছে কিছুটা রহস্যও। তবে এই অজ্ঞাত মহিলাটি কে ছিলেন, তা জানার যে আগ্রহ, কৌতূহল মানুষের মাঝে তা বুঝি আর কখনোই শেষ হবার নয়।
যদিও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বলেছিলেন, ঘটনার দিন শামীম ওসমানের পূর্বনির্ধারিত গণসংযোগ কর্মসূচি ছিলো। এই কর্মসূচিতেই হয়তো কারো সাথে না কারো সাথে ওই মহিলা এসেছিলেন। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, মহিলাটি যদি কারো সাথে এসেই থাকেন তাহলে তিনি নারায়ণগঞ্জের হবেন। আর তা হলে তার পরিবার থেকে কেউ না কেউ তাকে খুঁজতে আসতেনই। কিন্তু দীর্ঘ ২১ বছরেও কেউ তার খোঁজ নেননি।
অভিযোগ রয়েছে, বোমা হামলার ঘটনায় ২১ বছর ধরে কেবল রাজনীতিই হয়েছে, বিচারের দাবিতে জোরালো কোনো পদক্ষেপ কেউ গ্রহণ করেনি। বোমা হামলা ঘটনার পর দায়ের করা দু’টি মামলায় আদালতে চার্জশিট দেয়া হয়েলেও বিচারকার্য সম্পন্ন করা এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়ে ওঠেনি। প্রতিবছর এ দিনটি ঘটা করে পালন করা ছাড়া আর কিছুই হয়নি।
তবে সূত্র বলছে, চার্জশিট প্রদানের পর থেকে এখনও পর্যন্ত স্বাক্ষ্য গ্রহণই শেষ করতে পারেনি। যার কারণে এই মামলার রায় প্রদান করা সম্ভব হয়নি ২১ বছরেও। ১৬ জুন বোমা হামলার ঘটনায় নিহত ২০ জনের মধ্যে একজন নারীর পরিচয় আজও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কে ছিল সে নারী তার হদিস এখনও পর্যন্ত জানাতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ আওয়ামী লীগ দলীয় কেউ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৬ জুন বোমা হামলায় হতাহতের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলার একটি হত্যা ও অপরটি বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা। দুটি মামলার বাদী নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা।
দুইটি মামলায় জেলা বিএনপির তৎকালিন সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে প্রধান করে বিএনপি ও সহযোগি সংগঠনের মোট ২৭ জনকে আসামি করা হয়। মামলাটি এখন নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতে বিচারাধীন।
শামীম ওসমান আরো বলেন, এ মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে দেখি ঘটনার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আমি যে বক্তব্য দিয়েছিলাম তা পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। এজন্য আমি আদালতে সাক্ষ্য না দিয়ে এ মামলার অধিকতর তদন্ত দাবি করেছি।
হলি আর্টিসানের মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় আত্মগোপনে ছিল। জঙ্গিদের ক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তেমন উদ্যোগী দেখা যায় না। সেজন্য তিনি নারায়ণগঞ্জে আরও যোগ্য ও চৌকস কর্মকর্তা নিয়োগের দাবি জানান।
গত বছরের ২৩ মার্চ তার সাক্ষ্য প্রদানের কথা থাকলেও করোনার কারণে তার সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব হয়নি। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিনি আদালতে উপস্থিত হয়ে ১৬ জুনের বোমা হামলার ঘটনার পুনঃতদন্ত দাবি করেন।
তিনি বলেন, করোনা মহামারির কারণে গত ২ বছর আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। আমরা আশা করি, এখন এ মামলার কার্যক্রমে গতি আসবে।
এদিকে চার্জশিটে অভিযুক্ত ৬ জনের দুইজন দেশের কারাগারে ও দুইজন ভারতের কারাগারে এবং একজন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ও অপর একজন দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী। আদালতের নির্দেশে মামলাটি তদন্ত শুরু করে সিআইডি।
এর এক যুগ পর তথা ২০১৪ সালে ২ মে ৯৪৭ পাতার চার্জশিট প্রদান করে সিআইডি। চার্জশিটে বিএনপির ৩১ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং অভিযুক্ত করা হয় ৬ জনকে।
ফরিদপুর জেলার কোতয়ালী থানার ঝিলটুলী গ্রামের নজরুল বারীর ছেলে আনিসুল মোরসালিন এবং তার ভাই মাহবুবুল মোত্তাকিন, ক্রসফায়ারে নিহত যুবদল নেতা মমিনউল্লাহ ডেভিড ও মাহবুবুল্লাহ তপনের ছোট ভাই শাহাদাত উল্লাহ জুয়েল, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, উত্তর চাষাড়া এলাকার ওবায়দুল হক এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেমের ছোট ভাই ১২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু।
তাদের মধ্যে মোরসালিন ও মোত্তাকিন দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ভারতের একটি কারাগারে রয়েছেন। তাদের এদেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। তারা ১৬ জুন বোমা হামলার সাথে সম্পৃক্ত থাকার কথাও স্বীকার করেছেন। মুফতি হান্নান ও শাহাদৎউল্লাহ জুয়েল ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলাও মামলায় অভিযুক্ত। তাদের একজন কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অপরজন মুফতি হান্নানের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে।
এদিকে, ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বোমা হামলার ঘটনায় নিহত চা দোকানি হালিমা বেগমের ছেলে আবুল কালাম বাদি হয়ে শামীম ওসমান, তার ভাই নাসিম ওসমান, সেলিম ওসমান সহ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও এর সহযোগী সংগঠনের ৫৮ নেতাকর্মীকে আসামি করে একটি মামলা করেন। পরবর্তি সময়ে উচ্চ আদালত এ মামলাটি খারিজ করে দেন।
এমন নাটকিয়তায় এবং ২০০৩ সালে আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট করার মধ্য দিয়ে চাঞ্চল্যকর এই বোমা হামলা মামলাটি চলে যায় হিমাগারে।
মামলায় উল্লেখিত ২৭ জনের কেউই চাষাড়া আওয়ামী লীগ অফিসে ১৬ জুন ২০০১ সালের বোমা হামলায় জড়িত নয়। যদি ভবিষ্যতে অত্র মামলার তথ্য সম্বলিত ক্লু পাওয়া যায় তবে, মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার ব্যবস্থা করতে হবে।’
এমন বিভৎস আর বিভিষিকাময় পরিবেশ আমার জীবনে আর কখনো দেখিনি। ওই একবারই দেখেছিলাম নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলার ঘটনায়। এমন বিভৎস দৃশ্য রাব্বুল আলামিন যেন বাকি জীবনে আর না দেখায়। আমি তখন এই থানারই (ফতুল্লা মডেল থানা) সাব-ইন্সপেক্টর ছিলাম।
সন্ধ্যার পর খবর পেলাম নগরীর চাষাড়ায় আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে যেখানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার তখন তার পিছন দিকটাতেই ছিলো জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়। তাৎক্ষনিক সেখানে আমাদের ডাক পড়ে।
ডাক পেয়েই মুহূর্তে সেখানে ছুটে যাই। সেখানে গিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে কিছু সময়ের জন্য হতভম্ব হয়ে পড়ি। দেখি অফিসটির টিনের চালা উড়ে গেছে আর ভেতরে অসংখ্য মানুষ রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এ সময় তাদের আত্মচিৎকারে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠে। এরই মধ্যে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারাতে দেখি কয়েকজনকে।
কিছুক্ষণ থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি আবার বলেন, পরবর্তীতে নিজেকে সামলে নিয়ে আহতদের নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠাই। এরই মধ্যে নিজেই একজনকে কাঁধে তুলে নিয়ে খানপুর হাসপাতালে ছুটে যাই। সেখানে গিয়ে এ ঘটনায় নিহত আরও কয়েকজনের লাশ দেখতে পাই।
১৬ জুনের বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন শহর ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুল হাসান বাপ্পী। তার ছোট ভাই ও নাসিকের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কামরুল হাসান মুন্না বলেন, অতীতে এই মামলাটি নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ২০১৩ সালে মামলার চার্জশিট দেওয়ার পর বিচারের আশায় বুক বেঁধেছিলাম।
কিন্তু গত ২১ বছরেও বিচারকাজ শেষ না হওয়ায় বিচার পাওয়া নিয়েই হতাশ হয়ে পড়েছি। চার্জশিটভুক্ত ৬ জনই এত বড় ঘটনা ঘটিয়েছেন তা কোনোভাবেই বোধগম্য নয়। তারপরেও যদি বিচারকাজ শেষ হতো তাহলে নিহতদের আত্মা শান্তি পেতো। আমি নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার দাবি জানাচ্ছি।