সোমবার (১০ অক্টোবর) দুপুর ১টা ১০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেতুটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সেতুটি বন্দর উপজেলার মদনগঞ্জ এবং নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সৈয়দপুরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে । ফলে বন্দর উপজেলার লাখ লাখ মানুষ এই সেতুটি ব্যবহারে সুফল ভোগ করবে। সেই সঙ্গে পদ্মা সেতু দিয়ে যাতায়াত করা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষও মুন্সিগঞ্জ হয়ে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু দিয়ে মদনপুর হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যেতে পারবেন। ফলে রাজধানীর ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরের ওপর যানবাহনের চাপও কমে আসবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
নারায়ণগঞ্জবাসীর দীর্ঘ ১১ বছরের অপেক্ষার অবসান ৩য় শীতলক্ষ্যা সেতুর উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সড়কপথে সংযুক্ত হয়েছে নারায়ণগঞ্জের শহর ও বন্দর।
তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় সেতুর পূর্ব প্রান্তে এক বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমান, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু, নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা, জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ, জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল, ব়্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা, নৌপুলিশের নারায়ণগঞ্জ জোনের পুলিশ সুপার মীনা মাহমুদ, সেতুর প্রকল্প পরিচালক শোয়েব আহমেদ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই, সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত মো. শহীদ বাদল, মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি চন্দন শীল, সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা প্রমুখ।
সেতু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নারায়ণগঞ্জ সবদিকেই গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলা। অর্থনৈতিক ভাবে এবং সাংগঠনিক ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। নারায়ণগঞ্জের গুরুত্বপূর্ণকে বিবেচনা করেই এখানে ৩য় শীতলক্ষ্যা সেতু উদ্বোধন করলাম। এই সেতুকে কেন্দ্র করে ঢাকার যানজট কমবে। কার এই সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো ও চট্টগ্রামের মধ্যে যোগাযোগ সহজ হবে। সেতুটি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু পরিবারের জন্য প্রয়াত সামসুজ্জোহা ও নাসিম ওসমানের ত্যাগের কথা তুলে ধরেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সময় চোখের পানি মুছতে দেখা গেছে শামীম ওসমানকে।
এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শামীম ওসমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জে শুধু নাসিম ওসমান সেতুই দেননি তিনি আমার দাদার নামে খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম করেছেন, যা নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম। তিনি আমার আব্বার নামে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড দিয়েছেন, যা বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর রোড হবে। তার নামকরণ হবে একেএম সামসুজ্জোহা সড়ক। আমরা চাইনি তিনিই দিয়েছেন।
আমার মাকে তিনি অনেক ভালোবাসতেন। তিনি ভাষা সৈনিক ছিলেন। সেই মায়ের নামে চাষাঢ়া থেকে আদমজী পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার সড়ক হচ্ছে। এতে প্রায় ১০ থেকে ২০ লাখ লোক উপকৃত হবে। এছাড়া যে পরিমাণ কাজ নারায়ণগঞ্জে হয়েছে আমার মনে হয় আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করতে পারবো না।
প্রয়োজনে আবারও রক্ত দেওয়ার কথা তুলে ধরে শামীম ওসমান বলেন, নেত্রী বার বার একটা কথা বলেছেন, সাংগঠনিকভাবে এবং তার বিপদে নারায়ণগঞ্জের মানুষ তার পাশে ছিল। আজকে আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলতে চাই, যে কয়দিন বেঁচে আছি অতীতেও যেভাবে জাতির পিতার পরিবার, নিজের দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে এ পরিবারের পাশে ছিল, ইনশাআল্লাহ আগামীতেও জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার পাশে নারায়ণগঞ্জের মানুষ এভাবেই থাকবে। অতীতেও যেমন রক্ত দিয়েছে, আগামীতেও দরকার হলে রক্ত দিয়েই জাতির পিতার কন্যার যেই স্বপ্ন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে।
শহরের পুরাতন সৈয়দপুর এলাকার বাসিন্দা মোস্তফা মিয়া বলেন, বহু বছরের প্রত্যাশা ছিল এই শীতলক্ষ্যা সেতুর। প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষ নৌকা ও ট্রলারে খেয়া পারাপার হতো। এখন শহরের সঙ্গে বন্দরের যোগাযোগ সহজ হবে। ভোগান্তির অবসান হবে।
ফরাজীকান্দা এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ লুৎফর বলেন, আগে এখানে সেতু ছিল না, নদী পার হতে হতো নৌকায়। দুর্ঘটনায় অনেকের জীবন গেছে। আমরা এই সেতু পেয়ে খুশি।
এ সেতুটি নারায়ণগঞ্জ শহর ও বন্দর উপজেলাকে সংযুক্ত করায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। এখস আমরা নতুন করে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে বাঁচার কথা ভাবছি।
সেতুটির প্রকল্প পরিচালক শোয়েব আহমেদ জানান, ১ দশমিক ২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলগামী যানবাহন এবং একইভাবে চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলগামী যানবাহন যানজট এড়াতে এবং সময় বাঁচাতে নারায়ণগঞ্জ শহরকে বাইপাস করতে সক্ষম করবে। এটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে যানবাহনের ভ্রমণের সময় কমিয়ে দেবে। সেতুটির সঙ্গে নতুন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে পদ্মা সেতু থেকে জনগণ সর্বোচ্চ সুবিধা পাবে বলেও জানান তিনি।
এতদিন এই সেতুর দুই পাড়ের মানুষ ও অন্যান্য এলাকার জনসাধারণের পারাপারের প্রধান মাধ্যম ছিল মোটরচালিত নৌযান। তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু চালুর ফলে পঞ্চবটি বিসিক শিল্প এলাকা, পঞ্চবটি মোড়, চাষাঢ়া মোড়, সাইনবোর্ড, নারায়ণগঞ্জের চট্টগ্রাম সড়ক বা ঢাকার পোস্তগোলা ও শনির আখড়া রুটে যানবাহনকে তীব্র যানজটের সম্মুখীন হতে হবে না বলে জানান শোয়েব আহমেদ।
প্রকল্পটি ২০১০ সালে একনেকে অনুমোদন পেলেও ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রকল্প পরিচালক বলেন, সেতু নির্মাণে ৬০৮ দশমিক ৫৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এরমধ্যে ২৬৩ দশমিক ৩৬ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারের তহবিল থেকে এবং ৩৪৫ দশমিক ২০ কোটি টাকা সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) থেকে এসেছে।
ওয়াকওয়েসহ সেতুটিতে ৩৮টি স্প্যান রয়েছে। এরমধ্যে পাঁচটি নদীতে এবং ৩৩টি পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে। হাঁটার পথসহ সেতুটির প্রস্থ ২২ দশমিক ১৫ মিটার। এছাড়া, ছয় লেনের টোল প্লাজা এবং দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ রোডও নির্মাণ করা হচ্ছে।
শীতলক্ষ্যা নদী বন্দর উপজেলা ও সোনারগাঁ উপজেলাকে জেলা সদর থেকে পৃথক করেছে। এ দুটি উপজেলা সরাসরি সড়কপথে জেলা সদরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল না। দুই উপজেলা থেকে জেলা সদরে যেতে কাঁচপুর ব্রিজ (শীতলক্ষ্যা-১ সেতু) ব্যবহার করতে হতো, যার জন্য নৌকায় নদীপথের মাত্র ৩ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরত্ব সড়ক পথে প্রায় ৩০ কিলোমিটার ঘুরে যেতে হতো।
বন্দর উপজেলায় বসবাসকারী কয়েক হাজার মানুষ প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জে কাজের জন্য নৌকায় করে শীতলক্ষ্যা নদী পার হন। একইভাবে নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ থেকেও মানুষ নৌকায় শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ি দিয়ে বন্দর বা সোনারগাঁ উপজেলায় আসেন। নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুটি বন্দর উপজেলা ও জেলা সদরের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করবে।