যার কারণে সিলেট নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুণ্যভূমি। ধর্মীয় বিশেষণে আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসেবেও সমাদৃত।
সেই অলিকূল শিরোমণি হযরত শাহজালাল (র.) দরগাহ এলাকার উন্নয়নের ছোঁয়া লাগছে এবার।
প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে হযরত শাহজালাল (র.) দরগাহ এলাকাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
প্রয়াত এম. সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে মাজারের দৃষ্টিনন্দন ফটক, মেহমানখানা নির্মাণ করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে আরও ১০ কোটি টাকার উন্নয়ন হয়। তবে এবার সেই বাজেটের তিনগুণ বেশি অর্থ বরাদ্দ হয়েছে হযরত শাহজালাল (র.) মাজারের সার্বিক উন্নয়নে।
প্রায় ৭০০ বছর আগে সুদূর ইয়েমেন থেকে ১২ সহচর নিয়ে ইসলাম প্রচারে বের হন সূফী দরবেশ শেখ শাহ জালাল কুনিয়াত মুজাররদ (র.)। সিলেটে পৌঁছার আগে তার কাফেলা হয় ৩৬০ জনের। সঙ্গীদের নিয়ে গৌড় রাজ্যের জাদুবিদ্যায় পারদর্শী অত্যাচারী রাজা গৌড় গোবিন্দকে হটিয়ে সিলেটে ইসলামের পতাকা তুলেন হযরত শাহজালাল (র.)। তাই ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে এটি পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থী মাজার জিয়ারত করতে আসেন। এই মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বৃহৎ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারাও।
সিলেটে ঘুরতে আসা পর্যটকরাও একবার মাজার এলাকা ঘুরে যান। মাজারের জালালি কবুতর, পুকুরের বড় বড় গজার মাছ, কিংবা শাহজালালের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র পর্যটকদের আকর্ষণ করে। ফলে প্রতিদিনই দরগাহ এলাকায় ভিড় করেন দর্শনার্থীরা। দর্শনার্থীদের গাড়ি মাজারের সড়কে যত্রতত্রভাবে পার্কিংয়ের কারণে সব সময় যানজট লেগেই থাকে।
এছাড়া দূর-দূরান্ত থেকে রাতে যারা মাজারে আসেন, তাদের গাড়িতে বা খোলা আকাশের নিচেই রাত কাটাতে হয়। বাথরুম সুবিধাও যথেষ্ট নয়। ফলে ওরস বা এ রকম কোনো আয়োজনে মাজার এলাকায় বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থী জড়ো হলে সবাইকে পড়তে হয় বিপাকে। অবশ্য আগামীতে এসব বিড়ম্বনা-দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হবে না দর্শনার্থীদের।
পরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে বদলে দেওয়া হবে ওলিকূল শিরোমণির মাজার এলাকা। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে একটি বৃহৎ প্রকল্প নিয়েছে সরকার। সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) তত্বাবধানে এই প্রকল্পের মাধ্যমে মাজার এলাকাকে আরও বেশি দর্শনার্থী, মুসল্লি ও পর্যটকবান্ধব করে গড়ে তোলা হবে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিসিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রায় ৩০ কোটি টাকার এই প্রকল্প ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাস হয়েছে। শুধু অর্থ ছাড়ের অপেক্ষা। প্রকল্পের আওতায় দুই একর জমি অধিগ্রহণ, বহুতল পার্কিং প্লেস নির্মাণ, কবরস্থান সংস্কার, নারী ও পুরুষ দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্রামাগার এবং ৫০টি বাথরুম নির্মাণ ছাড়াও দরগাহ মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য চার তলা একটি আবাসিক হল নির্মাণ করা হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হওয়ায় নগরীর কেউ মারা গেলে হযরত শাহজালাল (র.) মাজার কবরস্থানেই তাকে দাফন করতে চান মৃতের স্বজনরা। কিন্তু কবরস্থানের জায়গা ছোট হওয়ায় এই চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মাজার কর্তৃপক্ষকে।
নগরবাসীর এই চাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে গৃহীত প্রকল্পে দরগাহ কবরস্থানকে সংস্কারের মাধ্যমে এর পরিসর বাড়ানো হবে। একই সঙ্গে এলাকার ভেতরে জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম দরগাহে হজরত শাহজালাল (র.) মাদরাসা নামে একটি প্রাচীন মাদরাসা রয়েছে। সেখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসিক সুবিধা না থাকায় তারাও নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। এই মাদরাসার জন্যও নির্মিত হবে বৃহৎ আবাসিক ভবন।
শাহজালাল (র.) মাজারের অবস্থান সিলেটে সিটি করপোরেশনের ১নং ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সৈয়দ তৌফিকুল হাদী বলেন, মাজার এলাকাকে ঘিরে একটি বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে মাজারের যেমন সৌন্দর্য বাড়বে তেমনি দর্শনার্থী ও এলাকাবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং মাজারে মরদেহ দাফন নিয়ে জটিলতাও দূর হবে। এ ছাড়া সড়কের শৃঙ্খলাও ফিরে আসবে।
তিনি জানান, মাজারে আগত যেসব নারী-পুরুষ খোলা ময়দানে রাত যাপন করেন, তাদের আর খোলা জায়গায় ফুটপাতে থাকতে হবে না। দর্শনার্থীর জন্য বড় থাকার জায়গা এবং তাদের জন্য ৫০টি বাথরুম নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের জন্য ফটক এলাকায় দুই একরের বেশি জমি অধিগ্রহণ করা হবে।
হযরত শাহজালাল (র.) মাজার সেক্রেটারি সামুন মাহমুদ বলেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম সাইফুর রহমান মাজারের ফটক ও মেহমানখানা করে দিয়েছিলেন। সাইফুর রহমানের স্ত্রীর টাকায় মাজার প্রাঙ্গণের টাইলস লাগানো হয়। এছাড়া সিলেট সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া অর্থে শৌচাগারের উন্নয়ন কাজ করা হয়। এছাড়া শাহজালাল (র.) মাজার, মাদরাসা, এবাদতখানা, সীমানাপ্রচীরসহ বিভিন্ন উন্নয়নে ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। এই উন্নয়ন হলে দূর দূরান্ত থেকে মাজারে আসা লোকজন সুবিধা ভোগ করবেন।
এ বিষয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, এই প্রকল্পটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ছাড় পেলেই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। এ প্রকল্পের আওতায় হযরত শাহজালাল মাজারকে মানিকপীর (র.)-এর মাজারের মতো সংস্কার করা হবে। মাজারের মূল ফটকে একটি বহুতল বিশিষ্ট পার্কিং জোন গড়ে তোলা হবে। যাতে মাজারে আসা লোকজনের গাড়ি আর রাস্তায় না থাকে। এই ভবনের পাশেই গড়ে তোলা হবে আরেকটি ভবন। যেখানে থাকবে কমিউনিটি হল। এছাড়া মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আবাসিক ভবনও তৈরি হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে হযরত শাহজালাল (র.) মাজার এলাকা নান্দনিক রূপ পাবে।