বিআরটিসি এবার চেসিস কিনে বাস বানাতে যাচ্ছে
মাহবুব আলমঃ
বিদেশ থেকে বাস আমদানি করে দীর্ঘদিন ধরে যাত্রীদের সেবা দিয়ে আসছে রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন (বিআরটিসি)। আমদানি করা একটি বাসের পেছনে কোটি টাকার বেশি খরচ হয়। এবার সেই প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে সংস্থাটি। বিআরটিসি নিজেরাই চেসিস (বাসের কাঠামো) কিনে বাস তৈরি করার উদ্যোগ নিচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় খরচ হবে কোটি টাকার কম। দেশের কয়েকটি বেসরকারি অটোমোবাইল ওয়াকর্শপে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একটি এসি বাস বানাতে চেসিসের দাম বাদে ৩৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা লাগে। নন-এসি বাস বানানো যায় ২০ লাখ টাকার মধ্যে। তবে বাসে কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে তার ওপর ভিত্তি করে মোট খরচ একটু কম-বেশি হতে পারে। বাংলাদেশ এখনো চেসিস আমদানি-নির্ভর দেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দেশীয় কোম্পানিগুলো চেসিস এনে বিক্রি করে। মান অনুযায়ী ৪০ থেকে ৭০ লাখ টাকায় ইঞ্জিনসহ চেসিস পাওয়া যায়। রাজধানীতে গণপরিবহনের স্বল্পতা ও চলাচলে বিশৃঙ্খলা ফেরাতে নানা উদ্যোগ নেয় সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার।
এর মধ্যে বেশকিছু ছিল স্রেফ লোকদেখানো। আর কিছু প্রচেষ্টা মোটেও ফলপ্রসূ ছিল না। ফলে বেসরকারি পরিবহনের ওপর ছিল মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতা। কিন্তু এক্ষেত্রে চলে যাত্রী টানার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এর জেরে দুর্ঘটনা ও যানজট দুটোই মারাত্মক ভুগিয়েছে। পাশাপাশি ছিল যাত্রীদের পকেট কাটার প্রবণতাও। এ থেকে উত্তরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানেও অতীতে চলেছে বাস ক্রয় ও মেরামতের নামে অনিয়ম-দুর্নীতি। সেই অবস্থা অনেকটা কেটেছে। এবার শুধু চেসিস আমদানির পর দেশেই বিআরটিসির নিজস্ব কারখানায় বাস তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে করে গণপরিবহনের চাহিদা অনেকটাই পূরণ হওয়ার পাশাপাশি আমদানিনির্ভরতা কমায় বিপুল অর্থের সাশ্রয় হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত বিআরটিসি দীর্ঘদিন লোকসান গুনেছে কেনাকাটা ও রক্ষণাবেক্ষণে অনিয়ম-গাফিলতির জেরে। তবে ২০২১ সালের পর এ থেকে উত্তরণ ঘটেছে, লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে বিআরটিসি। এখন নতুন করে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে নিজস্ব কারিগর দিয়ে গাজীপুর ও তেজগাঁওয়ে গাড়ি তৈরির। সাধারণত প্রকল্পের মাধ্যমে গাড়ি আমদানি করতে হলে ডিপিপি অনুমোদন, চুক্তি সই ও সরবরাহ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ন্যূনতম ৩ বছর লাগে। আর এখন কেবল চেসিস আমদানি করে বিআরটিসি দেশে বসে গাড়ি নির্মাণ করবে। এর ফলে একদিকে সময়ক্ষেপণের হাত থেকে রক্ষা মিলবে, অন্যদিকে আর্থিকভাবেও অনেক সাশ্রয় হবে।
বিআরটিসি চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম গনমাধ্যমকে বলেন, এবারই প্রথম বিআরটিসি নিজস্ব কারখানায় বাস তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। চেসিস আমদানির মাধ্যমে এ প্রক্রিয়াটি দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থের সাশ্রয় হবে এবং সময় বাঁচবে বহুগুণ। এ করপোরেশন লাভজনক হয়েছে কিছু পদক্ষেপের কারণে। নিজস্ব কারখানায় বাস তৈরির মাধ্যমে বিআরটিসি তথা দেশের জন্য বিরাট অর্জন হবে। এতে করে শুধু রাজধানীতেই নয়, সারাদেশে যাত্রীসেবায় বিআরটিসি আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদেশ থেকে একটি সাধারণ বাস আমদানি করতে হলে প্রতি ইউনিটের মূল্য পড়ে ৬৬ হাজার ডলার। তদুপরি রয়েছে ৩৫ শতাংশ সিডি/ভ্যাট। এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতির জেরে যোগ হয় আরও ১০ শতাংশ। সব মিলিয়ে প্রতিটি বাসের মূল্য দাঁড়ায় ৯৫ হাজার ৭শ ডলার বা প্রায় এক কোটি ১২ লাখ টাকা। কিন্তু নিজস্ব ওয়ার্কশপে বাস প্রস্তুত করলে ব্যয় অনেকটাই কমে আসবে। যেমন- অশোক লেল্যান্ড বাসের ইঞ্জিনসহ চেসিসের দাম ৪৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর বাসের সম্পূর্ণ বডি তৈরি ও অন্য মালামাল বাবদ খরচ ৮৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। হিনো ওয়ান জে বাসের ইঞ্জিনসহ চেসিস মূল্য ৫৩ লাখ টাকা। বাসের সম্পূর্ণ বডি তৈরি ও অন্য মালামাল বাবদ খরচ ৪০ লাখ টাকা। সব মিলে ৯৩ লাখ টাকা। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত একটি অত্যাধুনিক এসি বাসের ইউনিট মূল্য ১ লাখ ৪০ হাজার ডলার, সঙ্গে সিডি/ভ্যাট ও মূল্যস্ফীতি বাবদ যোগ হয় আরও ৪৫ শতাংশ বা ৬৩ হাজার ডলার। সব মিলিয়ে খরচ হয় প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর এ ধরনের বাস বিআরটিসির নিজস্ব ওয়ার্কশপে তৈরি হলে খরচ হবে ৯৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিআরটিসিতে গাজীপুরের সমন্বিত কেন্দ্রীয় মেরামতের কারখানা (আইসিডব্লিউএস) এবং কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানায় (সিডব্লিউএস) বড় ওয়ার্র্কশপ শেড আছে। সেখানে ইঞ্জিন ওভারহোলিং, মেশিনশপ ও গাড়ির বডি তৈরির কাজ করা সম্ভব। করপোরেশনের ওয়ার্কশপগুলোয় ডেন্টিং, পেইন্টিং, ওয়ার্কশপ-সংশ্লিষ্ট সব কাজের অত্যাধুনিক সরঞ্জাম আছে। আছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ প্রকৌশলী ও কারিগর। বিআরটিসি জানিয়েছে, সাধারণত ৪৫ আসনের একটি গাড়ির ক্রয়মূল্য এক কোটি টাকা। ধরা যাক ঢাকা-কুমিল্লা রুটে বাসটি চলাচল করে দেড় ট্রিপ দেয় প্রতিদিন। মাসিক আয় ৭ লাখ ৯৩ হাজার ৮০০ টাকা। বছরে আয় ৯৫ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ টাকা। আর আনুমানিক মাসিক গড় ব্যয় ৫ লাখ ৮৩ হাজার ৪৩০ টাকা। এর মধ্যে জ¦ালানি, লুব্রিকেন্ট, যন্ত্রাংশ, টায়ার, ভারী মেরামত, টোল/ ফেরি, বেতন-ভাতাও যুক্ত। সব মিলিয়ে এক বছরে আয় ৯৫ লাখ ২৫ হাজার ৬শ টাকা আর ব্যয় ৭০ লাখ ১ হাজার ১৬৭ টাকা। অর্থাৎ এক বছর অপেক্ষা করে নিট লাভ হবে ২৫ লাখ ২৪ হাজার ৪৩২ টাকা। এক কোটি টাকা নিট লাভ করতে লাগবে চার বছর। প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রজেক্টের অর্থসংস্থান বেশি থাকায় অনেক গাড়ি একত্রে আনা গেলেও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে। আরও অনেক সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যেমন- আমদানি খরচ বেশি। প্রজেক্টের মাধ্যমে গাড়ি সংগ্রহ করতে হলে দীর্ঘসময় লাগে এবং ক্ষেত্রবিশেষে গাড়ির গুণগত মানও যথাযথ থাকে না।