অসাম্প্রদায়িক চেতনার সুরস্রষ্টা চারণকবি বিজয় সরকারের ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ (৪ ডিসেম্বর)।
‘এ পৃথিবী যেমন আছে তেমনই ঠিক রবে, সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে/ পোষা পাখি উড়ে যাবে/ সজনি গো আমি একদিন ভাবিনী মনে/ ও তুমি জানো না জানো নারে প্রিয় তুমি মোর জীবনের সাধনা- এই সব বিখ্যাত মরমি গানের স্রষ্টা কবিয়াল বিজয় সরকার।
বিরল ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভা সম্পন্ন এই আধ্যাত্মিক পুরুষের গান আজও দেশের আনাচে কানাচে মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে।
দুই বাংলায় সমানভাবে জনপ্রিয় এই কবি শেষ জীবনে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার কেউটিয়া গ্রামে বসবাস করতেন। কবির ১ম স্ত্রী বীণাপাণি দেবী ও ২য় স্ত্রী প্রমাদা দেবী। কাজল অধিকারী, বাদল অধিকারী ও শ্রীমতী বুলবুল বিশ্বাস কবির সন্তান। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ১৯৮৫ সালের ৪ ডিসেম্বর জামাতা সুশীল কুমার বিশ্বাস ও কন্যা বুলবুল বিশ্বাসের হাওড়ার বাড়িতে মহান এই কবির দেহাবসান ঘটে। সেখানে কেউটিয়ায় তাকে সমাহিত করা হয়।
১৯০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নড়াইলের বাঁশগ্রাম ইউনিয়নের ডুমদি গ্রামে বাবা নবকৃষ্ণ অধিকারী ও মাতা হিমালয় অধিকারীর সংসারে জন্ম গ্রহণ করেন। দশ ভাইবোনের মধ্যে বিজয় ছিলেন সবার ছোট।
দীর্ঘ সংগীত সাধনার জীবনে প্রায় দুই হাজার গান লিখেছেন। বিচ্ছেদ গান, শোকগান, ইসলামীগান, আধ্যাত্মিক গান, দেশের গান, কীর্তন, ধর্মভক্তি, মরমি গান, বাউল, কৃষ্ণপ্রেম। গ্রামের নদী মাঠ আর প্রকৃতিতে ঘুরে বেড়ানো বিজয় সরকার ছোটবেলা থেকেই কবিতা আর গান লিখেন। নিভৃতচারী এই সংগীত সাধক আসরের প্রয়োজনে মঞ্চে বসেই গান রচনা করে তাৎক্ষণিকভাবে সুর করে তা পরিবেশন করেছেন। কবিগানের মধ্যে অশ্লীলতা দূর করে সবার জন্য উপযোগী করে কবিগান সমৃদ্ধ করে বাংলাদেশে জনপ্রিয় করে তোলেন বিজয় সরকার। তার ভক্তরা “সরকার” পরিচয়ে নড়াইল-যশোর-গোপালগঞ্জ-বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিজয়গীতি আর কবিগান পরিবেশন করেন। মহান এই চারণকবি ২০১৩ সালে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি হিসেবে মরনোত্তর একুশের পদকে ভূষিত হন।
প্রখ্যাত এই শিল্পীর গানের কোনো সংগ্রহ না থাকায় এ যুগের ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে দিনদিন হারিয়ে যেতে বসেছে তার সব বিখ্যাত মরমি গানসহ তার স্মৃতি। দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং বিদেশে মরমি গানের এই কবিকে নিয়ে নানা ধরনের চর্চা হলে ও তার জন্মভূমি নড়াইলে নেই কোনো একাডেমি বা চর্চা কেন্দ্র।
খুলনা বেতার বাংলাদেশ টেলিভিশনের ফোক গানের শিল্পী ও গানের শিক্ষক প্রতুল হাজরা বলেন, আমরা নিজেদের উদ্যোগে কবিয়াল বিজয় সরকারের গান চর্চা করি। শিল্পকলা বা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি বিজয় সরকার একাডেমি থাকলে ভালো হতো।
মূর্ছনা সঙ্গীত নিকেতনের সভাপতি শামীমূল ইসলাম বলেন, এটা খুবই লজ্জাজনক যে, চারণ কবি বিজয় সরকারের এলাকাতে তাকে মূল্যায়ন করা হয় না। তার গানের চর্চা হয় না। মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিজয় একাডেমি থাকলেও আমাদের এলাকাতে নাই।
চারণ কবি বিজয় সরকার ফাউন্ডেশনের যুগ্ম আহ্বায়ক আকরাম শাহীদ চুন্নু বলেন, একুশে পদকপ্রাপ্ত এই শিল্পীর জন্য আমাদের উদ্যোগ নেই। কলকাতায় তারা অনেক এগিয়েছে। আমার ব্যক্তি উদ্যোগে অনেক চেষ্টা করেছি মাত্র, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার।
আগে চারণ কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে তিন দিনের মেলাসহ নানা অনুষ্ঠান আয়োজন হলেও ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হবে স্বল্প পরিসরে। বিজয় সরকার ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। কবির বাড়ি ডুমদী’তে ভক্তরা পূজা ও নানা মানত করেন। কবির প্রতিকৃতিতে মালা দেন আবার মনোবাসনা পূর্ণ করতে মানত উপহার হিসেবে দিয়ে আসেন। ডুমদীতে স্থানীয় বিজয়ভক্তরা কবির গান দিয়ে স্মরণ করবেন।
মরমি এই শিল্পীকে জাতীয় চারণকবি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান, নড়াইলে বিজয় সরকারের নামে ফোকলোর ইনস্টিটিউট তৈরি, নিজ বাড়ি ডুমদি গ্রামে তার স্মৃতি সংগ্রহশালা স্থাপন করা হোক এটাই নড়াইলবাসীর প্রত্যাশা।