আহম্মেদ আলী
শীতকাল মানেই ভ্রমণের শুরু। যে সময়ে নেই ভয়াবহ গরমে ক্লান্ত হওয়ার ভয়, নেই বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত সড়কের ঝামেলা। তীব্র দাবদাহ। এজন্যই প্রকৃতিপ্রেমীরা ঘুরতে বেছে নেন শীতকালকে। সব মিলিয়ে শীতকাল ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। আর এই উপযুক্ত সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে দরকার উপযুক্ত জায়গা নির্বাচন করা।চলুন, শীতকালে নিরাপদে ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশের কয়েকটি জনপ্রিয় ৫টি স্থান সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
শীতকালে ভ্রমণের জন্য সবার প্রথমেই আমার লিস্টে থাকবে পৃথিবীর অন্যতম দুর্লভ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। খুলনা, সাতক্ষীরা আর বাগেরহাট জেলার কিছু অংশজুড়ে রয়েছে পৃথিবীর অপার বিস্ময়ের এই বন। অরণ্যপ্রেমী ও ওয়াইল্ড লাইফ যাদের পছন্দ তাদের জন্য সুন্দরবন একটি আদর্শ জায়গা। সুন্দরবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এ ছাড়া হরিণ, বানর, সাপ, কুমিরসহ অসংখ্য বন্যপ্রাণী ও পশুর অভয়ারণ্য। আমার ব্যক্তিগত মতামতে এতোসব কিছুর ঊর্ধ্বে সুন্দরবনের শব্দ সবার আগে স্থান পাবে। একটা পাতা পড়ার শব্দ, পানির শব্দ, বাতাসে গাছের শব্দ ও ছোট বড় খালগুলো আপনাকে নিয়ে যাবে এক নৈসর্গিক জাযগায়। তাই শীতকালে সুন্দরবন হতে পারে আপনার ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত জায়গা।
সুদৃশ্য পাহাড় চুড়া, স্বচ্ছ জলরাশি আর নানান রঙের নুড়ি পাথরের এক অপূর্ব সমন্বয় সিলেটের জাফলং। নগর সভ্যতার যান্ত্রিক কোলাহল ছেড়ে জীবন এখানে এসে মাথা লুকোয় একটু শান্তির খোঁজে। প্রকৃতির মায়াবী পরশে আনন্দে নেচে ওঠে মন। তাই ভ্রমণ মন কে পরিপূর্ণ করে তুলতে যে কেউ আসতে পারেন পাহাড়, পানি ও পাথরভরা রূপকথার রাজ্য জাফলংয়ে। তাছাড়া এখন যুক্ত হয়েছে নতুন একটি ঝরনা মায়াবী ঝরনা। প্রকৃতি কন্যা হিসেবে সারা দেশে এক নামে পরিচিত সিলেটের জাফলং। খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জাফলং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ জাফলংকে করেছে আকর্ষণীয়। সীমান্তের ওপারে ভারতীয় পাহাড়-টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরাম ধারায় প্রবহমান। জলপ্রপাত, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেল পানি, উঁচু পাহাড়ের গহিন অরণ্য ও প্রকৃতির শুনশান নীরবতা পর্যটকদের দারুণভাবে মোহাবিষ্ট করে। তাই যান্ত্রিক সভ্যতার সকল ব্যস্ততা ভুলে গিয়ে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও প্রকৃতির কাছে নিজেকে সঁপে দিতে প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি হাজারো পর্যটক ছুটে আসেন প্রকৃতিকন্যা জাফলংয়ে। জাফলং থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই পাবেন তামাবিল বর্ডার।
মায়াবী হরিণ, বিশাল কেওড়া বন আর নরম বালুর মাঝে অপরূপ সৈকত নিঝুম দ্বীপ। সাগরের জলরাশি আর ঢেউয়ের গর্জনের সঙ্গে হিমেল হাওয়ায় মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা লীলাভূমি এ দ্বীপে সৃষ্টিকর্তা সব রূপ ঢেলে দিয়েছেন। প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসু পর্যটক নিঝুম দ্বীপে ঘুরতে আসেন। নদী অববাহিকায় গড়ে ওঠা প্রাণ প্রকৃতির নৈসর্গিক দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের কোলে বালুচর বেষ্টিত ছোট্ট সবুজ ভূখণ্ড এটি। অগণিত শ্বাসমূলে ভরা কেওড়া গাছ দেয়াল বানিয়েছে দ্বীপের চারদিকে। পূর্বাকাশে জ্বলজ্বলে সূর্যের আলো সাগরের ছোট ছোট ঢেউগুলোয় ঝলমল করছে, সৈকতের কেওড়া বন পেরিয়ে অর্ধে হাওয়া এসে লাগছে গায়ে। নীল জলে সাতার কাটছে ছোট-বড় ট্রলার। সৈকত, কেওড়া বন, পাখি-প্রকৃতি, গ্রাম সবকিছু একত্রে দেখতে চাইলে যেকোনো পর্যটক যেতে পারেন নিঝুম দ্বীপ।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলা বাংলাদেশের চায়ের রাজধানী হিসেবে পরিচিত। শীতে শ্রীমঙ্গল গিয়ে ঘুরে আসতে পারেন বেশ কয়েকটি স্থানে। শ্রীমঙ্গল শহরটা ছোট, তবে বেশ গোছানো। এই শহরের বাড়ি, মসজিদ, মন্দির, গির্জাসহ সব স্থাপনার মধ্যেই নান্দনিকতার ছাপ আছে। শহরের বেশির ভাগ জায়গাজুড়েই রয়েছে চা-বাগান। এখানে আপনি যেদিকেই তাকাবেন, দেখবেন চায়ের বাগান, যা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাবে। যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজের হাতছানি। চা বাগানের সারি সারি টিলা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর ঘন সবুজ অরণ্যের অপরূপ সৌন্দর্য। শ্রীমঙ্গলের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে- লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, চা জাদুঘর, টি রিসোর্ট, ডিনস্টন সিমেট্রি, চাকন্যা ভাস্কর্য, নির্মাই শিববাড়ি, চা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন, খাসিয়াপুঞ্জি, টিপরা পল্লী, মনিপুরী পাড়া, গারো পল্লী, নীলকণ্ঠ টি কেবিন, বার্নিস টিলা, গলফ কোর্স, পাখি বাড়ি, বাদুর বাড়ি, লালমাটি পাহাড়, রাবার বাগান, আনারস বাগান, মাধবপুর লেক, হাইল হাওড়, বাইক্কা বিল প্রভৃতি।
পঞ্চগড় বাংলাদেশের হিমালয় কন্যাখ্যাত জেলা পঞ্চগড়। হিমালয়ের পাদদেশে জেলাটির ভৌগোলিক অবস্থান হওয়ায় পঞ্চগড়কে বলা হয় হিমালয় কন্যা। কাঞ্চনজঙ্ঘা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পর্বত। প্রতিবছর শীতের সময় বাংলাদেশ থেকে দেখা মেলে এই পর্বতের। পঞ্চগড় ও তেতুলিয়া থেকে স্পষ্টভাবে দেখা মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার। অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখা মেলে পর্বতের। শীতের আকাশ মেঘমুক্ত ও পরিষ্কার থাকায় ভেসে ওঠে তুষারশুভ্র হিমালয় ও কাঞ্চনজঙ্ঘা। তেঁতুলিয়া উপজেলা শহরের সরকারি ডাকবাংলো চত্বর কিংবা জিরো পয়েন্ট থেকে দেখা মেলে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম পর্বতের। পাশাপাশি স্পষ্টভাবে দার্জিলিংয়ের সবুজে ঘেরা পাহাড় শ্রেণীও দেখা যায়।