রাজধানীর শাহজাহানপুরে নাদিয়া নামে ১০ বছরের এক শিশু গৃহকর্মীকে নির্যাতন করে হত্যার ঘটনা ঘটে
চারদেয়ালে আটকে থাকে গৃহকর্মী নির্যাতনের খবর বুধবার, ০৮ মার্চ ২০২৩ চারদেয়ালে আটকে থাকে গৃহকর্মী নির্যাতনের খবর ফেব্রুয়ারির শেষে রাজধানীর শাহজাহানপুরে নাদিয়া নামে ১০ বছরের এক শিশু গৃহকর্মীকে নির্যাতন করে হত্যার ঘটনা ঘটে। নিহতের স্বজনদের অভিযোগ গৃহকর্ত্রী ফরহাদ বাঁধন মৌয়ের নির্মম নির্যাতনে প্রাণ হারায় নাদিয়া। বিষয়টি মিমাংসা করতে নগদ টাকা ও বাড়িতে পাকা ঘর দেওয়ার লোভ দেখান মৌ। এর আগেও মৌয়ের বিরুদ্ধে গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগ ছিল। নাদিয়ার মতোই রাজধানীসহ সারা দেশে গৃহকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্যাতনের এসব ঘটনা আটকে থাকে গৃহকর্তার চার দেয়ালের ভেতরেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অজ্ঞতা, ভয় ও প্রতিকার না পাওয়ার সংস্কৃতির কারণে কর্মক্ষেত্রে নির্যাতিত হলেও গৃহকর্মীরা কাউকে জানান না। আর এ কারণে ঝরে যায় অসংখ্য গৃহকর্মীর প্রাণ। স্মার্টফোন কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হলেও এই গৃহশ্রমিকরা জানেন না নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর সহায়তায় জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টারের নম্বর ১০৯ এর কথা। বেশিরভাগ গৃহকর্মী পরিবারের লোকজনকে নির্যাতনের কথা জানাতে পারেন না। আবার টাকার বিনিময়ে নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা পড়ার ঘটনাও আছে। আবাসিকে ৬৭ শতাংশ গৃহকর্মী মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। অনাবাসিকে এই হার ৬৬ শতাংশ। আবাসিকে ৬১ শতাংশ, অনাবাসিকে ৫৮ শতাংশ গৃহকর্মী মৌখিক নির্যাতনের শিকার হন। অন্যদিকে আবাসিকে ২১ শতাংশ ও অনাবাসিকে ১৮ শতাংশ শারীরিক নির্যাতন এবং আবাসিকে ৪ শতাংশ ও অনাবাসিকে ২ শতাংশ গৃহকর্মী কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের সম্মুখীন হন। ৯১ শতাংশ নারী গৃহকর্মী জেন্ডার সহিংসতার বিষয়ে সাহায্য চাইতে কোনো হটলাইন কিংবা হেল্পলাইন নম্বর সম্পর্কে জানেন না। আর ৯৯ শতাংশ গৃহকর্মীর তাদের সুরক্ষায় প্রণীত গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫ সম্পর্কে অবগত নন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) গৃহশ্রমিকদের অধিকার, মর্যাদা ও সুরক্ষায়, শোভনকাজ ও কর্মক্ষেত্রে জেন্ডার সহিংসতা: বাংলাদেশের নারী গৃহশ্রমিকদের পরিচালিত একটি গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য। ২০২২ সালে জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়কালে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, যশোরের ১৬৫ জন গৃহকর্মী ও ১৫০ জন নিয়োগকর্তার তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণাটি প্রণয়ন করা হয়। বিলস বলছে, ২০২২ সালের ১২ মাসে ৩৩ জন গৃহকর্মী হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আর ২০১১ থেকে ২০২১ এই ১০ বছরে হতাহত হয়েছেন ৫৮৫ জন গৃহকর্মী। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান বলেন, নির্যাতনের খবর যে কোথাও জানানো যায় এই তথ্যটা গৃহকর্মীদের কাছে নেই। জানালে যে প্রতিকার পাওয়া যায় এটা তার জানেন না। আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে এসব তথ্য প্রচার করি। কিন্তু গৃহকর্মীরা শিক্ষিত না হওয়ায় কিংবা অ্যাকসেস না পাওয়ায় টেলিভিশন কিংবা সংবাদপত্র থেকে তথ্যটা পায় না। আবার নিয়োগকর্তারাও ভয় দেখান। এ কারণে গৃহকর্মীরা কাউকে জানানোর চেষ্টা করেন না। তিনি বলেন, আমরা অনেক গৃহকর্মী পেয়েছি যারা স্মার্টফোন কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে পারদর্শী কিন্তু তারা একটা অক্ষরও লেখতে কিংবা পড়তে পারেন না। এই সময়ে তো নিরক্ষর থাকার কথা নয়, তারপরও অনেকে আছেন। গৃহকর্মী মাজেদা বেগম ১৩ বছর ধরে গৃহকর্মীর কাজ করছেন। বেশ কয়েকবারই গৃহকর্তী দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তবে কাজ হারানো শঙ্কায় নির্যাতনে ঘটনা কখনোই কাউকে বলেননি। তিনি বলেন, অনেক বাসায় মার খেয়েছি। গরম খুন্তির ছ্যাকাও খেয়েছি। ছোটবোন পাশের এলাকায় কাজ করেছে, তাকেও বলেনি। পরে চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। কোথায় বলবো এটাও জানি না, বললে যে একটা বিহিত হবে এটাও বুঝিনি। মাকসুদা নামের আরেক গৃহকর্মী জানান, ছোটখাটো ভুলে নেমে আসে শাস্তির খড়গ। কাউকে জানালে দেওয়া হয় চুরির অপবাদ কিংবা মিথ্যা অপবাদ। এ কারণে ভয়ে গৃহকর্মীরা কাউকে কিছু জানান না। বেসকারি সংস্থা কর্মীজীবী নারীর সিকিউরিং রাইটস অব উইমেন ডমেস্টিক ওয়ার্কাস ইন বাংলাদেশের প্রজেক্ট ম্যানেজার ফারহানা আফরিন তিথি বলেন, ভয়ের কারণে গৃহকর্মীরা নির্যাতনের কথা জানান না। এটা জানালে তাকে চাকরি হারাতে হবে- এমন ভয় থাকে সবসময়। এলাকা ছাড়তে হবে এমন মানসিকতা কাজ করে। মালিকপক্ষ যেহেতু পাওয়ারফুল, ফলে তিনি বিচার পাবেন না বলে গৃহকর্মীরা মনে করেন। সমাজের চোখে মেয়েরাই ভিকটিম হয়, মানুষ দোষ দেয়- এসব কারণে তিনি কাউকে জানান না। তিনি বলেন, এই ঘটনাগুলো তারা যদি পরিবার কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা হটলাইন নম্বরে আগে জানাতেন তাহলে হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা অনেক কমে যেতো। গৃহকর্মীদের জন্যও শোভন কাজের পরিবেশ নিশ্চিত হতো। সরকারের পক্ষ থেকে মনিটরিং সেল করা আছে। সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট থানায়ও মনিটরিং সেল আছে। যে কেউ সেখানে গিয়ে কমপ্লেইন করতে পারেন। এভাবে কিন্তু কয়েকটা মেয়ে উদ্ধারও হয়েছে। গৃহকর্মীরা যদি নির্যাতনের খবর আগে জানাতে পারেন তাহলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে বলে আমি মনে করি। বিলসের সহ-সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, গৃহকর্মীরা শ্রমিক হিসেবে এখনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি৷ তাদের কোনো নিয়োগপত্রও নেই। এসব কারণেই তারা এতটা নিগৃহীত। গৃহকর্মীরা ফৌজদারি অপরাধের প্রতিকার দেশের প্রচলিত আইনে চাইতে পারেন। তবে তাদের বেতন কম দিলে, বেতন না দিলে, অতিরিক্ত কাজ করালে, মানসিক নির্যাতন চালালে তারা কোনো প্রতিকার পান না। তারা সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করতে বাধ্য হন। অনেকক্ষেত্রে নির্যাতনের ঘটনা পরিবারকে জানানো হলেও তা টাকার বিনিময়ে রফাদফা হয় বলে মনে করেন সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, গৃহকর্মীরা যেহেতু দরিদ্র পরিবার থেকে আসেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগগুলো টাকার বিনিময়ে মিটমাট হয়। অপরাধী শাস্তি না পাওয়া, চিহ্নিত না হওয়ায় এ ধরনের অপরাধ ঠেকানো যাচ্ছে না। এমন ঘটনা আমরা দেখেছি, গৃহকর্মী পিটিয়ে হাত ভেঙে দিয়েছে। ওর চিকিৎসাও করেনি। পরে দারোওয়ান উদ্ধার করে আমাদের কাছে দেয়, আমরা মামলাও করেছিলাম অপরাধীর বিরুদ্ধে। কিন্তু ভিক