বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে দিনাজপুরে ৪ আগস্ট অনেকেই আহত হন। তাদের একজন দিনাজপুর শহরের কাঁটাপাড়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রশিদ।
আহত হওয়ার পরপরই পাল্টে যায় তার জীবনের দৃশ্যপট। সন্তান বিক্রির টাকায় চলছে তার চিকিৎসা।
৪ আগস্ট দুপুর। সন্তানসম্ভবা স্ত্রী রোকেয়া বেগমকে নিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আব্দুর রশিদ যান দিনাজপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। স্ত্রীকে রেখে নিচে নামলে চলমান সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তার পা, পেট, নাভি ও পুরুষাঙ্গে গুলি লাগে। পরে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে তিনি ভয়ে বাসায় চলে যান।
পেটের গুলিবিদ্ধ স্থানে পচন ধরলে পেশায় দিনমজুর রশিদ ৮ আগস্ট দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। রাতেই হয় অস্ত্রোপচার, এরপর আইসিইউতে। পরদিন বাড়িতেই ফুটফুটে এক কন্যসন্তানের জন্ম দেন স্ত্রী রোকেয়া বেগম।
এদিকে হাসপাতালে রশিদের চিকিৎসার সামগ্রিক খরচ আসে ৩৬ হাজার টাকা। এই অর্থ তার পরিবারের জন্য যে বোঝা! কেননা তার মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও নেই। থাকেন অন্যের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে। উপায় না পেয়ে হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ পরিশোধ করতে ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে গোপনে নিজের তিনদিনের শিশুকে অন্যের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন রশিদের স্ত্রী রোকেয়া।
রশিদের রোকেয়া বেগম বলেন, ঘটনার দিন আমাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পর আমার স্বামীর শরীরে গুলি লাগে। পরে ওই হাসপাতালে আমার স্বামীর চিকিৎসা হয়। চিকিৎসা শেষে স্বামীসহ আমি বাড়িতে চলে আসি। এরপর ৮ তারিখে আমার স্বামীর অবস্থা খারাপ হলে তাকে মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাতে অপারেশন হয় আর পরদিন আমার মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়।
তিনি বলেন, আমার আরেক সন্তান রয়েছে, সেও মেয়ে। আমার স্বামীর অপারেশনের জন্য বিভিন্ন ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনতে হয়। তিন দিনে হাসপাতাল ও আমাদের অন্যান্য খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৬ হাজার টাকা। এজন্য আমি ২৫ হাজার টাকায় আমার তিন দিনের সন্তানকে এক দম্পতির হাতে তুলে দিই। চিকিৎসক জানিয়েছেন, আমার স্বামীর আরও অপারেশন করতে হবে। কিন্তু তিনি পুরোপুরি সুস্থ হতে পারবেন না।
গুলিবিদ্ধ আহত আব্দুর রশিদ বলেন, ঘটনার পর থেকে আমি তো কাজ করতে পারিনি। আমার বাড়ি পঞ্চগড়ের ভজনপুরে। এখানে অন্যের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে আমি, আমার স্ত্রী ও সন্তানসহ থাকি। আমি যে গুলিবিদ্ধ হবো, তা চিন্তাও করিনি। আমার কোনো অপরাধ ছিল না, স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পর আমার শরীরে গুলি লাগে।
তিনি বলেন, প্রতিনিয়তই আমাকে হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। সেখান থেকে যেসব ওষুধ পাচ্ছি, সেগুলো ছাড়াও বাইরের দোকান থেকে ওষুধ কিনতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা ছাড়াও অনেকে সহযোগিতা করছেন। কিন্তু আমার আরও অপারেশন করতে হবে। আমার তো বাঁচতে ইচ্ছে করে। আমি আমার পরিবারের জন্য বাঁচতে চাই।
স্বামীর চিকিৎসার জন্য স্ত্রীর সন্তান বিক্রির বিষয়টি জানতে পেরে সোমবার বিকেলে আব্দুর রশিদের বাড়িতে যান দিনাজপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল রায়হান। তিনি বলেন, আমরা বাচ্চাটিকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। শিগগিরই বাচ্চাকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।