প্রয়াত বাবাকে শেষবারের মতো দেখার সুযোগ না পেলেও আশা ছিল অন্তত বাবার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বাবার জন্য পূকিন্তু নিয়তি কতটা নিষ্ঠুর, সেই সুযোগও পেলেন না দীপক। শ্রাদ্ধের ঠিক আগের দিন অন্য চার ভাইয়ের সঙ্গে দীপকের প্রাণও কেড়ে নিয়েছে একটি দুর্ঘটনা। সেদিন থেকে পরিবারটিতে চলছে প্রিয়জন হারানোর আর্তনাদ। পরিবারটিতে এখন চলছে শুধুই শোকের মাতম।
শুধু তাই নয়, একসঙ্গে পাঁচ ভাইকে হারিয়ে দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা প্লাবন সুশীল (২২) গতকাল থেকে পাগল প্রায়। এ পর্যন্ত কয়েকবার মূর্ছা গেছেন প্লাবন। তাকে মালুমঘাট খ্রিস্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। বুধবার বিকেল ৪টার দিকে অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
বুধবার (০৯ ফেব্রুয়ারি) সংক্ষিপ্ত পরিসরে পরিবারের কর্তা সুরেশ চন্দ্র সুশীলের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করা হয়েছে। শুক্রবার একইস্থানে হবে তার নিহত পাঁচ সন্তানের শ্রাদ্ধ। বার্ধক্যজনিত কারণে গত ২৮ জানুয়ারি মারা যান কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজরা ইউনিয়নের মালুমঘাট খ্রিস্টান হাসপাতালের সামান্য উত্তরে রিংভং হাসিনাপাড়ার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী সুরেশ চন্দ্র শীল। বুধবার তার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসারে সৎকার পরবর্তী সব নিয়ম পালন করতে শুরু করেন সুরেশ চন্দ্র শীলের ছয় ছেলে ও তিন মেয়ে। কিন্তু বাবার শ্রাদ্ধের একদিন আগে মঙ্গলবার ভোরে পার্শ্ববর্তী একটি বাগানে ক্ষৌরকর্ম পালন শেষে নয় ভাইবোন বাড়ি ফেরার পথে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে কক্সবাজারমুখী একটি মিনি ট্রাক তাদের চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই মৃত সুরেশ চন্দ্র শীলের ছেলে অনুপম সুশীল (৪৬), নিরুপম সুশীল (৪০), দীপক সুশীল ৩৫), চম্পক সুশীল (৩০) এবং পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর আরেক সন্তান স্মরণ সুশীল (২৫) মারা যান। আহত রক্ষিম সুশীলকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল (চমেক) থেকে নিয়ে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে।
ঘটনার পর থেকে শোকে মুহ্যমান তাদের মা মিলালিনি সুশীল মানু (৬৫)।
তিনি জানান, বাবার মৃত্যুর পর ৫ ফেব্রুয়ারি কাতার থেকে দেশে ফিরেছে দীপক। বিদেশ থেকে আসার পর এখনো ব্যাগও খুলেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চারদিন না খেয়ে ছিল সে। আমার অনুপম, নিরুপম, চম্পক, স্মরণও আর ফিরে আসবে না। এখন আমি কী নিয়ে বাঁচব। কান্না থামছেই না হতভাগী এই মায়ের।
‘এখন আমার সব শেষ হয়ে গেছে। এসব লিখলে কী আমার ছেলেরা ফিরে আসবে? আমার ছেলে হত্যাকারী চালককে যেন আটক করা হয়, প্রশাসনের কাছে সেই দাবি করছি। ’ বলেন তিনি।
‘তিল তিল করে তাদের মানুষ করেছি। ছেলেরা বড় হয়েছে,সবার পরিবার আছে। ছেলে সন্তান আছে। পরিবার নিয়ে একেক জন একেক জায়গায় থাকে। বাবার মৃত্যুতে সাত ছেলে বাড়িতে আসে। স্বামী হারানোর পর ছেলেদের নিয়ে বাকি জীবন বাঁচার স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু সেই স্বপ্নও চুরমার হয়ে গেছে।
বুধবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পুরো বাড়িতে সুনসান নিরবতা। বাড়ির আঙিনায় টাঙানো শামিয়ানা ও প্যান্ডেলে বাবার জন্য শ্রাদ্ধের কাজ চলছে। আগামীকাল শুক্রবার একই প্যান্ডেলে এক সঙ্গে পাঁচ ভাইয়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করা হবে।
বাড়ির উঠানের এক কোণে মাটিতে আপন মনে খেলা করছিল নিহত কাতার প্রবাসী দীপক সুশীলের একমাত্র ছেলে আয়ুস সুশীল (৬)। নিষ্পাপ শিশুটি এখনও জানেনা তার বাবা আর কোনো দিন তাকে আদর করবে না। মুখে চুমু খাবেনা।
শিশুটির মা এবং কাতারপ্রবাসী দীপক সুশীলের স্ত্রী পূজা সুশীল বলেন, ছেলে আয়ুসের বয়স এখন ছয় বছর। সে মালুমঘাট খ্রিস্টান মেমোরিয়াল স্কুলে কেজিতে পড়ে। দীর্ঘদিন তার বাবা বিদেশে থাকায় বাবার আদরটুকু সে পায়নি। এখন তাকে চিরকাল বাবাহীন থাকতে হবে।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, অনুপম সুশীল পেশায় পল্লী চিকিৎসক ছিলেন। বান্দরবান লামা উপজেলার আজিজনগর বাজারে তার চেম্বার করতেন। স্ত্রী পপি সুশীল, মেয়ে দেবশ্রী সুশীল (১৫) ও ছেলে অর্ক সুশীল (১১)। দেবশ্রী দশম শ্রেণী ও অর্ক পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে।
পপি সুশীল বলেন, অনুপম অনেক আশা করে কিছুদিন আগে একখণ্ড জমি কিনেছিলেন। সেখানে ঘর করার প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু এখন সেই স্বপ্ন তছনছ হয়ে গেছে। দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে জানিনা। পাচ্ছি না।
নিরুপম সুশীল ও স্ত্রী সীতা সুশীলের সংসারে কোনো সন্তান নেই। চম্পক সুশীলের পরিবারে স্ত্রী দেবী সুশীল ছাড়াও তাদের দুই সন্তান আয়ুশ্রী সুশীল (৪) ও দেড় বছরের আদ্রিতা সুশীল রয়েছে। স্মরণ সুশীলের পরিবারে স্ত্রী তৃঞ্চা সুশীল ছাড়াও আছে চার বছর বয়সী সন্তান অভি সুশীল। তার পরিবারে ২০ দিন বয়সী একটি কন্যা শিশু রয়েছে। শিশুটির নাম রাখা হয়নি এখনো।
ঘাতক পিকআপ জব্দ করা হলেও চালক এখনো পলাতক
চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারার রংমহল জঙ্গল থেকে চালকবিহীন একটি পিকআপ ভ্যান উদ্ধার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম থেকে পিকআপটি উদ্ধার করা হয়েছে। পরে পুলিশ পিকআপটি জব্দ করে হাইওয়ে থানায় নিয়ে যায়।
জব্দ করা পিকআপের চালক ও মালিককে এখনো আটক ও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ওই পিকআপে দুই বস্তা আলু পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করছেন, জব্দ তরকারি বোঝাই করা পিকআপের চাপায় পাঁচ ভাই নিহত হয়েছেন।
চকরিয়া সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মো. তফিকুল আলম বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ ভাই নিহত হওয়ার ঘটনায় প্লাবন সুশীল বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি দেখিয়ে মামলা দায়ের করেছেন।