চোরাগোপ্তা হামলা-বাসে আগুন প্রতিরোধে মাঠে ২০ হাজার পুলিশ-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে টানা কর্মসূচির অংশ হিসেবে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজধানীর নিরাপত্তা ও জনগণের চলাচল স্বাভাবিক রাখতে নানান পরিকল্পনা নিয়েছে ডিএমপি। এজন্য শনিবার ক্রাইম ও ডিবি পুলিশের কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন ডিএমপি কমিশনার অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান।
সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে টানা কর্মসূচির অংশ হিসেবে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। গত সপ্তাহে একদিন হরতাল ও তিনদিন অবরোধের পর চলতি সপ্তাহের শুরুতেই আবারও চলছে অবরোধ। আজ রোববার (৫ নভেম্বর) ভোর থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে শুরু হয়েছে টানা ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি। প্রথম ধাপের অবরোধে রাজধানী ও আশপাশের ১৯ জায়গায় বিভিন্ন যানবাহনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। তবে এবার যানবাহনে আগুন দেওয়া রুখতে আগে থেকেই নানান পদক্ষেপ নেয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
যদিও এরই মধ্যে শনিবার রাতে, রোববার সকাল ও রাতে রাজধানীর বেশ কয়েক জায়গায় বাসে আগুনের তথ্য এসেছে। রোববার সন্ধ্যা থেকে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত রাজধানীতে তিনটি বাসে আগুনের তথ্য মিলেছে। এর মধ্যে মিরপুরে দুটি ও বাংলামোটরে একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। পুলিশের নানান পদক্ষেপেও বাসে আগুন দেওয়া যেন কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
তবে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সে লক্ষ্যে নতুনভাবে নিরাপত্তার ছক তৈরি করেছে পুলিশ। এর অংশ হিসেবে রাজধানীতে দিনরাত দায়িত্ব পালন করছেন ২০ হাজার পুলিশ সদস্য। নাশকতা রোধে দায়িত্ব পালন করছেন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তারাও। একই সঙ্গে আছে র্যাব, বিজিবি, আনসার-ভিডিপিসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মূলত হরতাল-অবরোধে গণপরিবহনে চোরাগোপ্তা হামলা ও আগুন দেওয়ার ঘটনাই বেশি ঘটছে। চোরাগোপ্তা হামলা নিয়ে শঙ্কিত পুলিশও। এসব হামলা ও নাশকতা প্রতিরোধে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে ডিএমপি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, অবরোধ কেন্দ্র করে রাজধানীবাসীর নিরাপত্তায় এবার নেওয়া হয়েছে নতুন পরিকল্পনা। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষ্যে দিন ও রাতের রাজধানীকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। রাজধানীতে দিনে প্রায় ১১ হাজার পুলিশ সদস্য এবং রাতে প্রায় ৯ হাজার পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। থানা পুলিশ, পুলিশ লাইন্সের সদস্য, ডিবিসহ ঢাকা মহানগর পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে নিরাপত্তার এ ছক তৈরি করেছে ডিএমপি।
সাধারণত নাশকতা ও বাসে আগুন দেওয়ার বেশিরভাগ ঘটনা ঘটে রাতে। বিষয়টি মাথায় রেখে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা রাজধানীতে নিরাপত্তা জোরদার করেছে পুলিশ। পাশাপাশি রাজধানীতে যে কোনো ধরনের নাশকতা ও বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধে অপরাধীদের গ্রেফতার অভিযানও অব্যাহত রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা যে কোনো পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক নির্দেশ যেন পেতে পারেন, এ লক্ষ্যে এবারই প্রথম রাতে উপ-পুলিশ কমিশনাররা (ডিসি) দায়িত্ব পালন করছেন।
ডিএমপির আটটি ক্রাইম ডিভিশনে একজন করে উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) এ দায়িত্ব পালন করছেন। এর বাইরে নিয়মিত দায়িত্ব পালনে প্রতিদিন একজন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া চোরাগোপ্তা হামলা ও যানবাহন ভাঙচুর করে কেউ যেন পালিয়ে যেতে না পারে- সেজন্য রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে সাদা পোশাকের পুলিশ।
বৈঠকের বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপির এক কর্মকর্তা জানান, অবরোধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে ডিএমপি কমিশনার বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তিনি যে কোনো মূল্যে যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ প্রতিরোধের নির্দেশ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন্স) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার অবরোধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখে পোশাকধারী পুলিশ দিনে এবং রাতে দায়িত্ব পালন করছে। পাশাপাশি সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। এবার রাতের ঢাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাতে ডিসিরা দায়িত্ব পালন করবেন। আমাদের গোয়েন্দারাও কাজ করছেন। যে কোনো তথ্য পাওয়া মাত্রই নিরাপত্তার স্বার্থে যত ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, তাতে আমরা পিছপা হবো না। তাতে যদি কঠোর ব্যবস্থা নিতে হয় তবুও। আমাদের কাছে সবার আগে রাষ্ট্র, দেশের জনগণ। কাজেই নাশকতাকারীকে প্রতিরোধ করতে যত ধরনের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, ডিএমপি সব কাজ করবে।’
গত সপ্তাহে একদিনের হরতাল ও তিনদিনের অবরোধে রাজধানীতে বিভিন্ন জায়গায় চোরাগোপ্তা হামলা হয়েছে। যাত্রীবেশে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। পুলিশের নজর এড়িয়ে এসব হামলার ঘটনায় কিছুটা আতঙ্কে নগরবাসী।
শাহীন নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘গতকাল থেকেই বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা দেখছি। হঠাৎ করেই বাসে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। কে, কোথা থেকে, কীভাবে বাসে আগুন দিচ্ছে তা তো বলা যায় না। তাই আতঙ্ক নিয়েই কাজের জন্য বাইরে বের হতে হয়।
গণপরিবহনে চোরাগোপ্তা হামলার বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের বড় সমস্যা চোরাগোপ্তা হামলা। যাত্রীবেশে বাসে আগুন দিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। এরই মধ্যে আমরা দুই জায়গা থেকে দুটি গ্রুপ গ্রেফতার করেছি। এসব হামলাকারীকে ধরতে আমাদের গোয়েন্দা ও পুলিশ সদস্যরা সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখছেন। সবমিলিয়ে রাজধানীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা মোটামুটি স্বাভাবিক। রাস্তায় চলছে গাড়ি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে যত ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার আমরা নিয়েছি।’
হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে রাজধানীসহ সারাদেশে নিরাপত্তায় পুলিশের পাশাপাশি কাজ করছেন র্যাব, বিজিবি ও আনসার-ভিডিপির সদস্যরা। র্যাব সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে ৭০টি টহল দলে প্রায় ছয়শ র্যাব সদস্য বিভিন্ন সড়কে টহল দিচ্ছেন। এছাড়া দেশব্যাপী গোয়েন্দা নজরদারির জন্য র্যাবের গোয়েন্দারাও দায়িত্ব পালন করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অনলাইনেও নজরদারি রাখছে র্যাবের সাইবার মনিটরিং টিম।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, অবরোধ কেন্দ্র করে এরই মধ্যে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। ঢাকা ও আশপাশের জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে মোতায়েন করা হয়েছে ২৭ প্লাটুন বিজিবি। একই সঙ্গে আরও ১০ প্লাটুন বিজিবি প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এছাড়া অবরোধে যে কোনো ধরনের সহিংসতা এড়াতে সারাদেশে ৬৫ হাজার আনসার ও ভিডিপি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। রেল, সড়ক ও নৌ পথে যোগাযোগ নির্বিঘ্ন রাখতে ‘অপারেশন সুরক্ষিত যাতায়াত’ শুরু করেছে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর উপ-পরিচালক (প্রকল্প- প্রশিক্ষণ) ও গণসংযোগ কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘রোববার সকাল থেকে সোমবার পর্যন্ত দুদিন রেলওয়ে স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাটসহ সরকারি ও বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে আনসার ও ভিডিপি সদস্যরা মোতায়েন থেকে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন। রেললাইনে যে কোনো ধরনের নাশকতা প্রতিরোধে সারাদেশে এক হাজার ৪৭৬ পয়েন্টে ১০ হাজার আনসার-ভিডিপি সদস্য কাজ করছেন। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি ৫ হাজার ২৯৬ প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় ৫৫ হাজার অঙ্গীভূত আনসার নিয়োজিত রয়েছেন।