সিলেট, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ (বাসস): বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের ১৩ তম প্রয়াণ দিবস আজ। ২০০৯ সালের এই দিনে তিনি ইন্তেকাল করেন।
প্রতিবছর নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যদিয়ে দিবসটি পালিত হলেও ভয়াবহ বন্যা পরবর্তী নানা কারণে এবার তা হচ্ছে না। তবে পারিবারিক ও ঘরোয়া আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাউল সম্রাটকে স্মরণ করছেন তার ভক্ত অনুরাগীরা।
শাহ আব্দুল করিম ইব্রাহিম আলী ও নাইওরজানের ঘরে ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে পড়ালেখার সুযোগ হয়নি আব্দুল করিমের। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও করিম ছিলেন স্বশিক্ষিত। প্রতিদিনের জীবনের জাগতিক সুখ দুঃখ প্রেম ভালোবাসাকে আপন মহিমীয় তুলে ধরেছেন তার বাউল গানে। গানে গানে স্মরণ করেছেন স্রষ্টা ও সৃষ্টিকুলকে। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন স্বাধীকার আন্দোলনে বাউল সম্রাটের গান বাঙালীকে অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে। মরমী গান আর হৃদয় ছোয়া সুর তাকে হাওরের রাখাল বালক থেকে বাউল সম্রাটের আসনে আসীন করেছে।
শাহ আব্দুল করিমের জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে’, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম, গাড়ি চলে না, রঙ এর দুনিয়া তরে চায় না, তুমি রাখ কিবা মার ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে ময়ুুরপংখী নাও, তোমরা কুঞ্জ সাজাও গোসহ বহু গান রচনা করেছেন।
বাউল শাহ আব্দুল করিমের এ পর্যন্ত ৭টি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে। তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে তার রচনাসমগ্র (অমনিবাস)-এর মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। এছাড়াও সুমনকুমার দাশ সম্পাদিত শাহ আব্দুল করিম স্মারকগ্রন্থ (অন্বেষা প্রকাশন) তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। এর আগে-পরে শাহ আব্দুল করিমকে নিয়ে সুমনকুমার দাশের ‘বাংলা মায়ের ছেলে : শাহ আবদুল করিম জীবনী’ (অন্বেষা প্রকাশন), ‘সাক্ষাৎকথায় শাহ আব্দুল করিম’ (অন্বেষা প্রকাশন), ‘শাহ আবদুল করিম’ (অন্বেষা প্রকাশন), ‘বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম’ (উৎস প্রকাশন), ‘গণগীতিকার শাহ আবুল করিম’ (উৎস প্রকাশন) প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালে প্রথমা থেকে প্রকাশিত হয় সুমনকুমার দশের ‘শাহ আব্দুল করিম : জীবন ও গান’ বইটি। বইটিতে করিমের নির্বাচিত বেশ কিছু গানও সংকলিত হয়েছে। শাহ আব্দুল করিমের জীবনভিত্তিক প্রথম উপন্যাস সাইমন জাকারিয়া রচিত ‘কূলহারা কলঙ্কিনী’ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালে। বইয়ের তালিকা আফতাব সঙ্গীত (১৩৫৫ বাংলা; আনুমানিক ১৯৪৮), গণসঙ্গীত (১৯৫৭) কালনীর ঢেউ (১৩৮৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিন; ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বর), ধলমেলা (১৩৯৬ বঙ্গাব্দের ১ ফাল্গুন; ১৯৯০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি), ভাটির চিঠি (১১ বৈশাখ ১৪০৫; ২৪ এপ্রিল ১৯৯৮), কালনীর কূলে (নভেম্বর ২০০১), শাহ আব্দুল করিম রচনাসমগ্র (সংকলন ও গ্রন্থন: শুভেন্দু ইমাম, ২২ মে ২০০৯) বাউল শাহ আব্দুল করিম ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন। বাংলা একাডেমি তার দশটি গানের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে। শাকুর মজিদ তাকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন ভাটির পুরুষ নামে একটি প্রামাণ্য চিত্র। এছাড়াও সুবচন নাট্য সংসদ তাকে নিয়ে শাকুর মজিদের লেখা মহাজনের নাও নাটকের ৮৮টি প্রদর্শনী করেছে। তাকে একুশে পদক (২০০১) কথা সাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরি পদক (২০০০) রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার (২০০০) লেবাক এ্যাওয়ার্ড (২০০৩) মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার আজীবন সম্মাননা (২০০৪) সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস আজীবন সম্মাননা (২০০৫) বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি সম্মাননা (২০০৬) খান বাহাদুর এহিয়া পদক (২০০৮) বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী সম্মাননা (২০০৮) হাতিল এ্যাওয়ার্ড (২০০৯) এনসিসি ব্যাংক এনএ সম্মাননা (২০০৯) প্রদান করা হয়েছে।
২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম সিলেটের একটি ক্লিনিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সাম্প্রতিককালের ভয়াবহ বন্যায় বাউল সম্রাটের স্মৃতি যাদুঘরের ভবন ও সংগ্রহশালার বিভিন্ন উপকরণের ক্ষতি হয়েছে। বন্যা পরবর্তী নানা কারণে বাউল সম্রাটের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার গ্রামের বাড়িতে তেমন কোনো আয়োজন নেই। পারিবারিক আয়োজন ও স্থানীয় শিল্পীদের ঘরোয়া আয়োজনে পালিত হচ্ছে বাউল সম্রাটের প্রয়াণ দিবস। বাউল করিমের নিজ বসতভিটায় রেখে যাওয়া সংগীত বিদ্যালয়ের সংস্কার এবং প্রস্তাবিত বাউল একাডেমি নির্মাণে সরকার সংলিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন সংগীত অনুরাগীরা।
এদিকে সরকারি পৃষ্টপোষকতা বাউল সম্রাটের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালনের দাবি জানিয়েছেন বাউলের একমাত্র পুত্র বাউল শাহ নূর জালাল। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা তার জীবদ্দশায় মানুষের জন্য গান লিখেছেন। দেশের বিভিন্ন স্বাধীকার আন্দোলনে তার রচিত গান মানুষকে উৎসাহ দিয়েছে। তার অসংখ্য গান লোক সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছে। ইচ্ছে থাকলেও বাবার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে তেমন কিছু করতে পারিনা।’ সরকারি পৃষ্টপোষকতায় জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালনের পাশাপাশি তার স্মৃতি রক্ষায় বাউল একাডেমি স্থাপনের জন্য তিনি দাবি করেন।
দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান মামুন জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের স্মৃতি জাদুঘরের সংস্কার ও প্রস্তাবিত বাউল একাডেমি নির্মাণ কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।